শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়লেই কি নারীর ক্ষমতায়ন হবে
২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর বারবার একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে, আন্দোলনে বিপুলসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ সত্ত্বেও সরকার, সংস্কার কমিশন, টাস্কফোর্স, এমনকি পাবলিক আলোচনায় নারীদের অংশগ্রহণ কম কেন? এ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অস্বস্তিতে পড়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিনিধি হিসেবে এক–দুজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করার ঘটনাও ঘটেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নারীরা যোগ্য হলেও কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেছে, কোনো ক্ষমতা না দিয়ে টোকেন হিসেবে তাঁদের রাখা হয়েছে।
নারীরা যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নীতিনির্ধারণে বা রাজনীতিতে অংশ নিলেও তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন অনেক ক্ষেত্রেই অবমাননাকর। তবে আশার বিষয়, এসব সত্ত্বেও আমাদের দেশের নারীদের অনেকেই এ ধরনের কটূক্তি উপেক্ষা করে চলেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের কাজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নারী ক্ষমতায়নের প্রশ্ন এলে এই যে শহুরে নাগরিক সংস্কৃতিতে নারীর আধিক্যকে নারী ক্ষমতায়ন হিসেবে উদ্যাপন করা হয়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এই আধিক্যকে কি সব ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন বলা যাবে?
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রংপুরে বাংলাদেশ কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের আয়োজনে কৃষক কনভেনশনে আলোচক হিসেবে গিয়েছিলাম। আসন গ্রহণ করতে গিয়ে দেখি, সমাবেশে অধিকাংশই নারী। একজন নারী হিসেবে যেকোনো জায়গায় নারীদের উপস্থিতি যে একাত্মবোধ তৈরি করে, সেই বোধ আমাকেও অনুপ্রাণিত করেছিল। ফেসবুকে সমাবেশের ছবি দিয়ে যখন লিখি ‘অধিকাংশই নারী’, অনেকেই আমার মতো ভেবেছিলেন, কৃষিতে নারীরা অগ্রসর ভূমিকা পালন করছেন।
এর আগেও রংপুরে আখচাষিদের সমাবেশে গিয়েছি, কিন্তু এত নারী কৃষক দেখিনি। এবার উপস্থিতি ছিল ভিন্নধরনের কৃষকদের। এর ফলে মনে প্রশ্ন জাগে, কৃষিকাজে এত নারী কোথা থেকে এলেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, দেশজুড়ে কৃষি খাত যে ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে, তাতে কাজের সন্ধানে ভূমিহীন পুরুষ কৃষক ও খেতমজুরেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে বা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। এনজিও ও মহাজনদের কাছে ঋণভারে জর্জরিত হয়ে কেউ কেউ পরিবার রেখে পালিয়ে গেছেন। অথবা ঋণ পরিশোধ করতে কৃষিকাজ ছেড়ে শহরে রিকশা চালাতে বা দিনমজুরের কাজ করতে চলে গেছেন। আর বাড়িতে রয়ে গেছেন নারীরা।
এই নারীরাই একই সঙ্গে সন্তান লালন–পালন করছেন, আবার নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে খেতমজুরের কাজ করছেন। দেখা হলো কুঁজো হয়ে যাওয়া এক প্রৌঢ় নারীর সঙ্গে; ১০ থেকে ১১ বছর বয়সী এক নাতনির কাঁধে ভর দিয়ে মিছিলে হাঁটছেন। জানা গেল, তাঁর ছেলেও কাজের সন্ধানে অন্যত্র গিয়েছেন। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য টাকা পাঠাতে পারছেন না।
বাধ্য হয়েই এই নারীরা এসেছেন কৃষিকাজে। আমরা মনে করি, নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়াই উচিত। তবে কৃষকসমাবেশে দূরদূরান্ত থেকে আসা এই নারীদের পেছনের কাহিনি প্রশ্ন তৈরি করে, শুধু অংশগ্রহণ বাড়াই কি নারীর ক্ষমতায়ন? নারী ক্ষমতায়ন বলতে তাহলে আমরা কী বুঝব?
- ট্যাগ:
- মতামত
- নারীর ক্ষমতায়ন
- শ্রমবাজার
- নারী অধিকার