রাষ্ট্র সংস্কার ও নৈতিক বিপ্লব

যুগান্তর ড. আবদুল লতিফ মাসুম প্রকাশিত: ০৯ মার্চ ২০২৫, ১১:০১

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রকে নৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে বর্ণনা করেছেন। নৈতিকতা হচ্ছে রাষ্ট্রের ভিত্তি। রাষ্ট্র যেহেতু সমাজের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান, সেজন্য রাষ্ট্রকেন্দ্রিকই হতে হবে নৈতিক বিপ্লব। আমাদের চারপাশে নানা ধরনের সামাজিক-অসামাজিক, নৈতিক-অনৈতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মানবিক চাহিদা পূরণের প্রথা ও ব্যবস্থা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিনোদনমুখী ও ক্রীড়ামোদি দল, সংগঠন, ক্লাব ইত্যাদি। এগুলোর দুটো চেহারা রয়েছে-একটি দৃশ্যমান ও অনুমোদিত। অপরটি অদৃশ্য ও অ-অনুমোদিত। রাষ্ট্র যেহেতু একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান এবং নৈতিক উৎকর্ষ সাধন এর লক্ষ্য, সেজন্য সরকার তথা Management Of The State সমাজবহির্ভূত ও অকল্যাণকামী কিছুর স্বীকৃতি দেয় না, যদিও সমাজ ও সরকারের সামনেই এসব প্রতিষ্ঠান ক্রিয়াশীল থাকে। রাষ্ট্র ও সরকার যদি হয় অনৈতিক, অন্যায়ের ধারক এবং অনিষ্টকারী, তাহলে জাতি ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা ছড়িয়ে পড়ে। আর তার নেতৃত্ব যদি হয় বেআইনি, বেপরোয়া ও বেহিসাবি, তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রে অবারিতভাবে বেড়ে ওঠা বিনোদন ক্লাব যখন ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে কলঙ্কিত হয়, তখনই শাসকদের টনক নড়ে। তাতেও স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির উৎপাত লক্ষ করা যায়। রাষ্ট্র ও সরকারের নীতিই যখন দুর্নীতি হয়ে দাঁড়ায়, তখন রাষ্ট্রের বিপর্যয় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বারংবার দুর্নীতির হিসাব-নিকাশ বিশ্বব্যাপী চ্যাম্পিয়ন হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের নৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রামাণ্য হয়ে ওঠে। নৈতিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজকে পরিচালনার যে প্রথাগত দায় রাষ্ট্রের রয়েছে, তা অপসৃত হয়ে অন্যায়-অনিয়ম প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করে। এভাবে নীতি-নৈতিকতার অবসান রাষ্ট্রের নাগরিকদের সংক্ষুব্ধ করে তোলে। অ্যারিস্টটলের বিবেচনায় এসব উক্ত ও অনুক্ত অনুভূতি এবং কার‌্যাবলি গণঅভ্যুত্থান তথা বিপ্লব সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লবের এ রকম একটি তাত্ত্বিক পটভূমি নির্মাণ করা যায়।


নৈতিকতার ব্যাখ্যাটি সাধারণভাবে কোনো মানদণ্ড বা নীতিমালা হিসাবে উপস্থাপিত হয়, যা নির্দিষ্ট কোনো আদর্শ, ধর্ম বা সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এছাড়া এটি এমন বিষয় থেকেও আসতে পারে, যা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণকর হিসাবে বিবেচিত হয়। নৈতিকতাকে ‘সঠিকতা’ বা ‘ন্যায্যতা’ হিসাবেও অভিহিত করা যায়। নৈতিকতার আদর্শের মধ্যে নীতিবিদ্যা অন্তর্ভুক্ত থাকে, যেখানে নৈতিক বৈশিষ্ট্য, উক্তি, প্রবণতা এবং বিচারের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়। নৈতিকতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো-‘আমাদের উচিত অন্যের সঙ্গে সেভাবেই আচরণ করা, যেমনটা আমরা নিজেদের জন্য অন্যের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি।’ অপরদিকে অনৈতিকতা নৈতিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত, যা অসচেতনতা, অবিশ্বাস ও উদাসীনতার প্রতিফলন। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনবোধের সঙ্গে নৈতিকতার একটি অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। মানুষকে আল্লাহতায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত বলে বর্ণনা করেছেন। নৈতিকতা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। আবার সেই মানুষই তার কর্মদোষে নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়। আল কুরআনে বারবার এ কথাও বলা হয়েছে, মানুষ কতই না নিকৃষ্ট, কতই না অকৃতজ্ঞ। বস্তুত নৈতিকতা অর্জনের জন্য মানুষের কাছে কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই। তাকে একটি সাধনা, প্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিকতার মাধ্যমে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। নৈতিক জীবন গঠন করতে হয়। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবেশ, মানুষকে নৈতিকতার অনুবর্তী করে তোলার জন্য সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিলেই কেবল, একটি নৈতিক বিপ্লব সম্পন্ন হতে পারে। নৈতিকতাই মানুষের জীবনের ভালো-মন্দ, উৎকর্ষ-অপকর্ষ ও ন্যায়-অন্যায়ের ধারক হয়ে দাঁড়ায়। নৈতিক মূল্যবোধ বস্তুত মানুষের জীবনে অনুসরণযোগ্য এমন কিছু আচরণ বা বিধিব্যবস্থা, যা মানুষের জীবনপদ্ধতিকে সুন্দর, সৌজন্যমূলক ও সুশোভন করে তোলে। নৈতিকতা মানুষকে অন্যায় করার প্রবণতা থেকে রক্ষা করে। স্বার্থপরতা পরিহার করে মানবিকতার পথে উদ্বুদ্ধ করে। নৈতিকতা মূলত একটি সুদৃঢ় মানসিক শক্তি, যা মানুষকে অন্যায় প্রত্যাখ্যান করতে শেখায়। আর সব ধর্মই নৈতিকতার প্রধান আধার। ধর্মই মানুষকে সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে ও অন্যায়ের প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করে। তাই মানুষের নৈতিক তথা আত্মিক উৎকর্ষের জন্য রাষ্ট্রকে সুপরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা নিতে হবে।



নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে যে শিক্ষা-দীক্ষা আমরা প্রাথমিকভাবে লাভ করি, তাতে এরকম কথা আছে : ‘When Money is Lost, Nothing is Lost. When Health is Lost, Something is Lost. But When Character is Lost, Everything is Lost.’ বিদ্বজ্জনদের এ উক্তিটি আমরা যখন ব্যক্তিগতভাবে বিবেচনা করি, তখন সামান্য ক্ষতির কথা মনে হয়। কিন্তু যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি প্রায়োগিক হয়ে দাঁড়ায়, তখন মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় দেশ, জাতি, রাষ্ট্র। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে অতীতের কথন সুখকর নয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যতাড়িত জাতি আমরা। স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, পাশবিকতা, নোংরা নির্মমতা আমাদের বৈশিষ্ট। এসব প্রকৃতিগত অনৈতিকতা ফুলে-ফলে মহিরুহ হয়েছে বিগত আওয়ামী শাসনের ১৫ বছরে। চোর, চোট্টা, গুণ্ডা, পাণ্ডা, বাটপাড়, বদমাইশে ভরে গেছে দেশ। সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, বাজিকরে ভরে গেছে দেশ। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেছিলেন ‘এদের দেখলে চোর বলুন’। আওয়ামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণপদকে চুরির সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছিলেন, স্বর্ণকার মায়ের সোনাও চুরি করে। ছাত্রলীগের গুণ্ডা বাহিনীকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তিনি। নির্লজ্জের মতো নিজের পিয়নের শত কোটি টাকা চুরির গর্ব করলেন তিনি। আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মীকে লুণ্ঠন করার সুযোগ দেওয়াকে তিনি নৈতিক মনে করতেন। শুধু অর্থনীতি নয়, নৈতিকতার বিষয়টি তো সামগ্রিক। রাজনীতিকে তিনি ম্যাকিয়াভেলি এবং চানক্যের অনৈতিক ব্যাখ্যায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, ম্যাকিয়াভেলির সেই উক্তি, শাসক হবে শেয়ালের মতো ধূর্ত এবং সিংহের মতো সাহসী। ক্ষমতার জন্য কোনো কিছুই অন্যায় নয়। বিগত ১৫ বছরে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তিনি নষ্ট করেছেন। জাতীয় সংসদকে তামাশার সংসদ, মার্কসীয়দের ভাষায় শুয়োরের খোঁয়াড় বানিয়েছিলেন। আমলাতন্ত্রকে আওয়ামীতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। বিচার বিভাগকে অবিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন। এভাবে এক বিচারকের ভাষায় বাংলাদেশকে তারা জাহান্নামে পরিণত করেছিলেন।


অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। শেখ হাসিনার অন্যায়, অনিয়ম, নির্দয়তা, ভীতির রাজত্ব এবং ক্ষমতার অসম্ভব কেন্দ্রীকরণ শেখ হাসিনাবিরোধী গণঅভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তুলেছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং রাজনৈতিক শক্তি গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে রাষ্ট্রসংস্কারের কথা জোরেসোরে বলেছে। কার্যত রাষ্ট্রসংস্কারের প্রত্যয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের সব শক্তি ব্যয় করছে। অনেক কমিশন গঠিত হয়েছে। জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী হয়তোবা সংবিধান সংশোধিত হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার হবে এবং আগামী নির্বাচিত সরকার অসমাপ্ত সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, জাতির মৌলিক সংকট নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা-সমালোচনা ও সংস্কার প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়নি। একটি জাতির প্রাণশক্তি নির্ভর করে নাগরিক সাধারণের নৈতিক ভিত্তির ওপর। সেই নৈতিক ভিত্তি যদি নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে তার ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদও ধসে পড়বে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব সরাসরি নৈতিক বিপ্লব বা নৈতিক সংস্কারের পক্ষে যথেষ্ট কথাবার্তা না বললেও সেখানে নৈতিকতার একটি অনুক্ত অধ্যায় ছিল। অন্য ভাষায় একে বিপ্লবের হৃদপিণ্ড বলা যেতে পারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষণা ও কার্যক্রম ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম। তারা যখন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চায় এবং নিশ্চিত করে, তখন নৈতিকতার একটি অনুক্ত লক্ষ্য অর্জিত হয়। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রতিটি দফায় ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি বা ছাত্রলীগের নির্মমতার দ্বারা তারা যেভাবে হত্যা ও নির্মমতার শিকার হয়েছে, সেখানে ছাত্রলীগের নিষিদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি নৈতিক বিপ্লব অর্জিত হয়েছে। পরবর্তীকালে ছাত্ররা বিগত অর্ধ শতাব্দীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থার স্তরে স্তরে জমে থাকা আবর্জনা পরিষ্কার করতে চেয়েছে। রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলগুলো সর্বস্তরের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংযোগ রেখে সংস্কারের কার‌্যাবলীকে আংশিক বা পুরো সমর্থন দিয়েছে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও