
১২ বছরেও কেন খুনিদের বিচার হয় না
২০১৩ সালের ৬ মার্চ। নারায়ণগঞ্জের সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথ থেকে ত্বকীকে তুলে নিয়ে যায় খুনি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এর নেতৃত্বে ছিলেন ওই অঞ্চলের খুনি মাফিয়া হিসেবে পরিচিত ওসমান পরিবারের এক ছেলে। ত্বকীকে তাঁরা নিয়ে যান তাঁদের টর্চার সেলে। বহুজন মিলে এই কিশোরের ওপর তাণ্ডব চালান। এর বর্ণনাও একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। একসময় ছেলেটি মারা গেলে খুনিরা তাকে ভাসিয়ে দেন শীতলক্ষ্যা নদীতে।
এই কিশোরের অপরাধ কী ছিল? ও গল্প লিখত, কবিতা লিখত, ছবি আঁকত আর প্রচুর পড়তে ভালোবাসত। ঘরে অনেক বইপত্র। সেগুলো পড়ে আরও পড়ার জন্য পাঠাগারে যেত। তবু ওর পরীক্ষার ফল সবার চেয়ে ভালো হতো। পাঠাগারে যাওয়ার পথেই ওকে তুলে নিয়ে হত্যা করে শয়তানগোষ্ঠী।
শীতলক্ষ্যা নদী এই খুনিদের বহু বর্বরতার সাক্ষী। ত্বকীর আগে ও পরে এই নদীতে এই খুনিদের হাতে নিহত আরও বেশ কয়েকজনের লাশ পড়েছে। এই দুর্বৃত্তরা অবিরাম নৃশংস অপরাধ করেছে। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এদের বরাবর রক্ষা করেছে। ত্বকীর বাবা শিল্পী, সংগঠক রফিউর রাব্বি এসবের বিরুদ্ধে বরাবর সরব থেকেছেন। জনগণকে সংগঠিত করেছেন। সরকারি ক্ষমতার জোরে যে দুর্বৃত্তরা যা খুশি তা–ই করত, তাদের কাছে এটা ছিল অসহ্য। তাই তারা উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য রাব্বির সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
না, থামেননি রাব্বি। থামেননি তাঁর সহযোদ্ধা নারায়ণগঞ্জের লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, বাম রাজনৈতিক কর্মীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা মাফিয়াদের তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ–প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছেন। তাঁদের অসাধারণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে গড়ে উঠেছে ‘সন্ত্রাসবিরোধী ত্বকী মঞ্চ’। এই মঞ্চ ত্বকী হত্যাসহ সব রকম সন্ত্রাস, দখলদারত্ব আর লুটপাটের বিরুদ্ধে এত বছর ধরে সরব থেকে দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে।
প্রবল আন্দোলন হয়েছিল। ফলে ত্বকী হত্যার এক বছরের মাথায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল কেন, কখন, কোথায়, কারা এবং কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করেছে। কিন্তু খুনি শনাক্ত হওয়ার পরপরই সবকিছু আটকে যায়। সংসদে দাঁড়িয়ে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেন, এই খুনি দখলদার চাঁদাবাজ লুণ্ঠনকারী ওসমান পরিবারের পাশে তিনি সব সময়ই আছেন। তার পর থেকে আর এই বিচারকাজ একবিন্দুও অগ্রসর হয়নি। তবে শেখ হাসিনাসহ এই দুর্বৃত্তরা গণ–অভ্যুত্থানে ভেসে গেছে। কিন্তু তাদের বিচার এখনো হয়নি। অন্যান্য আরও হত্যাকাণ্ড, লুট, জুলুমের অপরাধসহ ত্বকী হত্যার বিচার থামিয়ে দেওয়ায় খুনিদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও শেখ হাসিনার বিচার হতে হবে।
শুধু ত্বকী হত্যা নয়, এর আগে ও পরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অসংখ্য খুন ও গুম হয়েছে। এসবের কোনো বিচার হয়নি। আয়নাঘরের কথা আমরা এখন একটু একটু করে জানতে পারছি। এই জুলুমবাজ সরকারের পতন হওয়ার পর সবার মধ্যেই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে এবার প্রশাসন, থানা, আদালত এসব বিচারকাজে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু সাত মাস পার হওয়ার পরও এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
হাসিনা আমলে বহুল অলোচিত আরও কয়েকটি ঘটনার বিষয় এখন আরও বেশি সামনে আনা দরকার। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ১৩ বছর পার হয়েছে। বারবার আদালত তারিখ পিছিয়েছেন। হাসিনার পরও একই ধারা অব্যাহত আছে। কুমিল্লায় সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ ও হত্যার পরও ৯ বছর পার হয়েছে। এগুলোর সাধারণ তদন্তও এখনো শেষ হয়নি। এই সাত মাসেও এটি নিয়ে কোনো অগ্রগতি দেখিনি। মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড মামলারও কোনো অগ্রগতি নেই। উল্টো শুনানি ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিরপরাধ প্রতিষ্ঠার সংগঠিত চেষ্টা দেখা গেছে। সরকার পতনের পরও এর কোনো খোঁজখবর নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতা, বিশেষত তরুণ সংগঠকদের খুনের বহু ঘটনা আছে। এগুলো নিয়ে তদন্ত আর বিচারের কথা আগে তেমন শোনা যায়নি। এখনো যায় না।
বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল পাকিস্তান থেকে গুণগতভাবে ভিন্ন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ পাকিস্তান মডেলেই চলেছে। পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবার নামক ক্ষুদ্র–বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আর তার সঙ্গে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র দেশ নিয়ন্ত্রণ করত। বাংলাদেশেও সেই ব্যবস্থা চলেছে। গত সরকারের আমলে তা আরও পোক্ত হয়েছে। স্বৈরশাসনের ক্ষমতা দিয়ে গণতান্ত্রিক সব ব্যবস্থাকে অচল করা হয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানকে দুমড়ে–মুচড়ে ফেলা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি।