
ব্যক্তিস্বার্থের উপরে দেশের স্বার্থ
একটি জাতির উন্নতি নির্ভর করে তার নাগরিকদের দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের ওপর। দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতা যদি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে না ওঠে, তবে সেই জাতি কখনোই উন্নতির শীর্ষে পৌঁছাতে পারে না। যেসব দেশ ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশপ্রেম ও জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তারা উন্নতি লাভ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের উদাহরণ হয়ে উঠেছে। জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, ফিনল্যান্ড, চীন ও নরওয়ে তাদের মধ্যে অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত জার্মানিকে পুনর্গঠন করা হয়েছে জাতীয় ঐক্য ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে। দেশটি পুনর্গঠনে ভক্সওয়াগন, বিএমডব্লিউর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিগত মুনাফার চেয়ে জাতীয় অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আবার ১৯৫০-এর কোরীয় যুদ্ধের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত দক্ষিণ কোরিয়ার পুনর্গঠনে জনগণ ও কোম্পানিগুলো (স্যামসাং, এলজি ও হুন্দাই) জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে অর্থনীতি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে নজিরবিহীন অগ্রগতি অর্জন করেছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউর নেতৃত্বে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জাপানের পুনর্গঠন, ফিনল্যান্ডের শিক্ষা খাতের উন্নয়ন, রুয়ান্ডার গণহত্যা-পরবর্তী উন্নয়ন, চীনের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক সংস্কার এবং নরওয়ের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয়েছে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশপ্রেম ও জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে।
মানুষ জন্মগত ও সংস্কৃতির প্রভাবে নিজের ও পরিবারের যত্ন ও সুরক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে, যা প্রশংসনীয় একটি কাজ। কিন্তু এ ব্যক্তিস্বার্থের কাজটি যখন জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে যায়, তখন তা ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করে। যেসব দেশ জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে, সেসব দেশ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সিরিয়া, লিবিয়া, দক্ষিণ সুদান, ভেনিজুয়েলা, ইয়েমেন, হাইতি ও সোমালিয়ার কথা বলা যেতে পারে। বাশার আল-আসাদের শাসন ও বিরোধী দলগুলোর ব্যক্তিগত ক্ষমতার লড়াই সিরিয়াকে ধ্বংস করে দিয়েছে। লিবিয়ায় ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতার লোভের কারণে তেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও জনকল্যাণ উপেক্ষিত হয়েছে। এছাড়া হাইতি ও দক্ষিণ সুদানের দুর্নীতি, ভেনিজুয়েলার জনসাধারণের দরিদ্রতা, ইয়েমেনের ক্ষমতার লড়াই, সোমালিয়ার সংঘাত ও জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার মূল কারণ হচ্ছে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এ উদাহরণগুলো প্রমাণ করে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশের কল্যাণকে স্থান না দিলে কোনো দেশ স্থায়ী উন্নয়ন করতে পারে না।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ। দেশটিতে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে কাজ করার মানুষ যেমন আছে, তেমনি জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মানুষও আছে। সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতা, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদরা তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও স্বার্থ ত্যাগ করে স্বাধীনতার (জাতীয় স্বার্থ) জন্য লড়াই করেছেন এবং দেশকে স্বাধীন করেছেন, যা দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ দেশপ্রেমিকদের ত্যাগ ও অবদান আজও আমাদের জাতিকে অনুপ্রাণিত করে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশপ্রেমিকদের দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীলতা প্রকাশ পেয়েছে জাতীয় সংকট মোকাবিলা, পরিবেশ রক্ষা, কর প্রদান, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সামাজিক ও অন্যান্য জনহিতকর দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে জাতীয় স্বার্থ থেকে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়, যাদের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই জাতির কল্যাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও অন্যান্য পেশাজীবী নিজেদের স্বার্থকে দেশের সুশাসন ও জনগণের কল্যাণের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং বিভিন্ন অপকর্ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের ক্ষতি করেছেন। অর্থ পাচার, কমিশন ব্যবসা, সিন্ডিকেট বাণিজ্য, সোনা চোরাচালান, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পক্ষপাত এবং ব্যাংকিং, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি তারই প্রমাণ বহন করে। এসব কাজ করার জন্য তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। সব রাজনৈতিক দলেই এ ধরনের ব্যক্তি আছেন। তাদের কারণে দলের সত্যিকারের নেতা, যারা দেশ ও দলের মঙ্গলের জন্য চিন্তা ও কাজ করেন, সর্বদা অবহেলা ও বঞ্চনার স্বীকার হয়েছেন। ব্যক্তিস্বার্থের কর্মকাণ্ড দল ও দেশকে উন্নয়ন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, যার ফলস্বরূপ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সাধারণ মানুষ আস্থা হারায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অধঃপতন নেমে আসে। বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অধঃপতন তারই প্রমাণ বহন করে। কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। তাই দেশের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলেও ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ চাঁদাবাজি ও দখলের হাতবদল, বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ, মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধের কথা বলা যেতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দেশের স্বার্থে
- দেশপ্রেম
- জাতীয় ঐক্য