সংস্কারের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের
মনজিল মোরসেদ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র অ্যাডভোকেট। তিনি ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ (এইচআরপিবি)-এর প্রেসিডেন্ট। জনস্বার্থে এ পর্যন্ত তিনি ২২৫টির বেশি মামলা করে মানবাধিকার ও পরিবেশ সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।
সংবিধান সংস্কারের খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
মনজিল মোরসেদ: কিছু প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আমি সংস্কার কমিশনকে ধন্যবাদ দিতে চাই, কিছু প্রস্তাবের ব্যাপারে আমি নিন্দা জানাতে চাই আর কিছু প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বলতে চাই, কমিশন কাউকে সহায়তা করার জন্য প্রস্তাবগুলো দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কোনো ব্যক্তি দুবারের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করা হবে। প্রস্তাব অনুযায়ী এসব কাজ করা হলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের জন্য ভালো হবে এবং জনগণের উপকার হবে। এগুলো অনেক মানুষের মাথায় ছিল। এসব প্রস্তাব করায় আমি তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই।
সংবিধানের কতগুলো মৌলিক ব্যাপার আছে। ’৭১ সালে যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়, তখন আমাদের কোনো লিগ্যাল ডকুমেন্ট ছিল না। সেই দলিল তৈরি হয়েছিল ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে। সেই দলিলের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে সংবিধান গ্রহণ করার আগপর্যন্ত সেটার ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছিল। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাটা হলো আমাদের ‘ভিত্তিমূল’। কিন্তু বর্তমান সংস্কার কমিশন সেটা বাতিল করার সুপারিশ করেছে। যেকোনো দেশের সংবিধানে একটা প্রস্তাবনা থাকে। সেই প্রস্তাবনা প্রেক্ষাপট, সময়—এগুলোর ওপর ভিত্তি করে করা হয়। সংবিধানের সেই প্রস্তাবনাকে পরিবর্তনের কথা কমিশন বলেছে। এটা নিন্দনীয় ব্যাপার। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন বিষয়টা ধরে সবকিছু নির্ধারণ করা হয়েছিল। ৫৪ বছর পর সেটা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। আমি এটার শুধু সমালোচনা না করে সরাসরি নিন্দা করছি। কারণ, এটা একটা গর্হিত কাজ হয়েছে। মানে, মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করা হয়েছে। যুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, আমার দৃষ্টিতে সেটাকে ছোট করা হয়েছে।
কিছু জায়গায় কাউকে সহায়তা করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব আনা হয়েছে। বর্তমান সংবিধানে প্রার্থী হওয়ার বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ বছর। কারণ এই সময়ের মধ্যে সাধারণত একজন ব্যক্তির পড়াশোনা সমাপ্ত হয়ে যায়। তারপর তিনি পেশাজীবনে প্রবেশ করেন। পেশাজীবনে তিনি রাজনীতিতে আসতেই পারেন। এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ২১ বছর। আমার কাছে মনে হচ্ছে, নতুন যে রাজনৈতিক দলের কথা শোনা যাচ্ছে, তার দিকে দৃষ্টি রেখেই এই প্রস্তাব করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, ২১ বছরে তো কারও মাস্টার্সই শেষ হবে না। তাহলে তাঁরা পড়াশোনা শেষ না করেই রাজনীতিতে চলে আসবেন। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই রাজনীতিতে চলে আসবেন। এতে আমাদের শিক্ষিত জাতি গঠনের প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। আবার সংস্কার প্রস্তাবে আনা হয়েছে, প্রতিটি দলের জন্য নমিনেশন প্রার্থী ১০ শতাংশ তরুণ-তরুণীদের জন্য নির্ধারিত থাকতে হবে। এটাও করা হয়েছে বিশেষ একটা গোষ্ঠীকে সহায়তা করার জন্য।
’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতির অধিকাংশ বাতিল করার প্রস্তাব কি যৌক্তিক মনে হয় আপনার কাছে?
মনজিল মোরসেদ: ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতি তো সেই সময়ই নির্ধারিত হয়েছে। তারপর ’৭৪ সালে যদি কিছু মূলনীতি সংযোজন করা হয়ে থাকে, সেটা সংশোধনের প্রস্তাব করা যেত। কিন্তু ’৭২ সালে এ দেশের জনগণ যে মূলনীতি গ্রহণ করেছে, সেটা তো পরিবর্তন করা যায় না। এবার বড় যে পরিবর্তনটা আনা হয়েছে, সেটা হলো ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হয়েছে। সেই সময়ের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। কারণ, আমরা পাকিস্তানের ইতিহাস জানি। পাকিস্তান আমলে বিভিন্নভাবে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। সে কারণে সব ধর্মের মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিল। উদ্দেশ্য, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সে কারণে সেই সময় সংবিধানে নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম রাখা হয়নি। কারণ, ধর্ম সবার ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে থাকবে। আর ধর্মনিরপেক্ষতা কাজ করবে রাষ্ট্র পলিসির ক্ষেত্রে। কিন্তু সেই ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এতে সংবিধানের বড় বিচ্যুতি ঘটেছে এবং এটা উদ্দেশ্যমূলক বলে আমার মনে হয়। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সমাজতন্ত্র যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এটাকে এখন বাদ দেওয়া অযৌক্তিক হবে না। কারণ, তার বিপরীতে সাম্য, সমতা শব্দগুলো পরবর্তী সংশোধনে চলে এসেছে।
‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি’ সংবিধানের এই ধারা বিলুপ্তের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এ নিয়ে আপনার মত কী?
মনজিল মোরসেদ: এটাও বিতর্ক সৃষ্টির জন্য করা হয়েছে। এটা তারা করতে পারে না। কারণ, আপিল বিভাগের একটা জাজমেন্ট আছে। আমরা জাতীয় পরিচয় কীভাবে দেব, সেটা সেখানে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আপিল বিভাগ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এ দেশের মানুষ বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশি পরিচয় দেবে। আর নিজ দেশের মধ্যে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেবে। এ বিষয়গুলো রায়ের মধ্যে নির্ধারিত করা হয়েছে। তাই এগুলোকে বিতর্কিত করার সুযোগ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার করবে, নির্বাচিত সরকার সেটা মানবে—এমন নিশ্চয়তা কি আছে?
মনজিল মোরসেদ: সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি আগেও বলেছি, বর্তমান সরকারের সংবিধান সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন আইন নিয়ে রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে পারে। কারণ, রাষ্ট্রপতিকে সরকার যা বলে, তিনি তা-ই করেন। এ জন্য তারা আইন করতে পারে। এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তারা এসব কেন করছে? কারণ, মানুষ কিছু পরিবর্তন চায়, এসব আলোচনা চলছে। নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো না কোনো দল তো ক্ষমতায় আসবে। মানুষ কী চায়, সেটা বিবেচনা করে কমিশন যদি আলোচনাগুলো তুলে ধরত, তাহলে ভবিষ্যতে যে ক্ষমতায় আসবে, তারা সেসব করতে পারত। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করে যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করছে, সেগুলোর তেমন কোনো মূল্য নেই। নির্বাচিত হয়ে যারা সরকার গঠন করবে, তারা যদি এসব প্রস্তাব পালনে অনাগ্রহী হয়, তাহলে অন্য কারও কিছু করার সুযোগ নেই।
এখন বড় দল হিসেবে বিএনপি আছে। নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে বলে অনেকের ধারণা। তাই বিএনপির কনসেন্ট নিয়ে সংস্কার প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করা হলে ভবিষ্যতে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এখন বিএনপি যেসব বিষয়ে দ্বিমত করছে, সেসব বিবেচনায় না নিয়ে সংস্কার করা হলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেসব মেনে নেবে বলে আমার মনে হয় না। তাহলে তো প্রস্তাবগুলো স্বাভাবিকভাবেই ভেস্তে যাবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সংবিধান সংশোধন