নতুন অধ্যাদেশে চিকিৎসকদের সুরক্ষা কতটা গুরুত্ব পেল
বিগত এক দশক বা তার বেশি সময় ধরে সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর ক্রমাগত শারীরিক আঘাতের ঘটনা বেড়ে গেছে। এর ফলে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্য থেকে তাদের জন্য একটি ‘সুরক্ষা আইন’ তৈরির দাবি জোরেশোরে তোলা হয়েছে। এ সময়ে স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
এ রকম প্রেক্ষাপটে বিগত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০২৩’–এর খসড়া নিয়ে হাজির হয়েছিল। তখন দেখা গিয়েছিল, খসড়া আইনটি স্বাস্থ্যসেবাদাতাদের চেয়ে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতাদের সুরক্ষাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে একই বিষয়ে একটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে যাচাই–বাছাইয়ের জন্য ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই খসড়ায় আগের মতো একই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
অধিকাংশ চিকিৎসক এখনো মনে করেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা আইন বা অধ্যাদেশ কার্যকর হলে তা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দেবে; কিন্তু অধ্যাদেশের খসড়া দেখে তা মোটেও সঠিক বলে মনে হচ্ছে না। যে কেউ এ খসড়া অধ্যাদেশ পড়লে দেখতে পাবেন, একমাত্র ধারা ৪২–এর উপধারা–৩ ব্যতীত আর কোথাও স্বাস্থ্যসেবাদাতাদের সুরক্ষার কথা বলা হয়নি। তাহলে শুধু স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতাদের সুরক্ষার জন্য এই পৃথক আইন করার প্রয়োজন পড়ল কেন? এমন প্রশ্ন উঠেছে।
এই দেশে অনায়াসে কোনো চিকিৎসক চাইলেই প্রাইভেট প্র্যাকটিসে এক দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ৫০/৭০/১০০/১৫০ জন রোগী দেখতে পারেন। যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে চিকিৎসক হিসেবে সরাসরি কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চিকিৎসকদের সঙ্গে সরাসরি গবেষণার অভিজ্ঞতায় আমি অন্তত এটুকু বলতে পারি, পৃথিবীর আর কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো এত আয়েশে, কোনোরকম নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
বিখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্র অলীক সুখ–এর প্রফেসর অম্বরিশ রায়ের মতো বলতে হয়, ‘চার-পাঁচ মিনিটে কি রোগীর মন বোঝা যায়? রোগীর মন না বুঝলে কি রোগ বোঝা যায়?’
সার্জন বা শল্যচিকিৎসকদের অবস্থা তো আরও তুঙ্গে। সরকারি হাসপাতালে দিনের পর দিন ঘোরে, পায়ের জুতা ক্ষয় করে ফেললেও সেখানে সার্জারির জন্য ভর্তি হওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে দালালকে টাকা না দিলে সার্জারি ডেট পাওয়া যায় না।
অথচ পকেটের টাকা খরচ করলেই জাদুকরের জাদুর কাঠির মতো সকাল বিকেল রাত যেকোনো সময় পাশের বেসরকারি হাসপাতালে সার্জারিটি করানো সম্ভব। রোগী বা তাঁর পরিবারের পক্ষে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির খরচ, বেড বা রুম ভাড়া, পরীক্ষা–নিরীক্ষার খরচসহ নামে–বেনামে বিভিন্ন খরচ করতে পারলেই হলো।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বাংলাদেশ মেডিকেল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল কি কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছে?
অন্য দেশের উদাহরণ
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) শুধু ২০২৩-২৪ সালে বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসায় অবহেলাজনিত ১৩ হাজার ৭৮৪টি অভিযোগ গ্রহণ করে এবং জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিলকে (জিএমসি) রেফার করে দেয়। জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল তার মধ্যে ৭ হাজার ২৬০টি অভিযোগের ক্ষেত্রে কমিটি দ্বারা প্রমাণসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং ৬ হাজার ৫৭৩টির ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বাতিল করে দেয়। এনএইচএস বছরে গড়ে ১৪ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করে শুধু ভুল চিকিৎসায় ক্ষতিগ্রস্ত রোগীদের সারিয়ে তোলার পেছনে। (দ্য গার্ডিয়ান, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪)
পাশের দেশ ভারতে গড়ে বছরে প্রায় কয়েক হাজার চিকিৎসায় অবহেলা–সংক্রান্ত অভিযোগ ভোক্তা অধিকার–সংক্রান্ত আদালতে (কনজ্যুমার কোর্ট) দাখিল হয়। আদালত পর্যালোচনা ও শুনানি করে আমলযোগ্য অভিযোগগুলোকে রাজ্যভিত্তিক স্টেট মেডিকেল কাউন্সিলে পাঠিয়ে দেন। স্টেট মেডিকেল কাউন্সিল আরও যাচাই-বাছাই করে তা মেডিকেল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ায় রেফার করে দেন। এখানে বলে রাখা ভালো, এই অভিযোগগুলোর মধ্যে বৃহৎ অংশই ভোক্তা অধিকারসংক্রান্ত আদালতের বাইরে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আইন
- সুরক্ষা
- চিকিৎসক
- স্বাস্থ্য খাত