পুরস্কারের নামে হেনস্তা
কয়েক দিনের ব্যবধানেই পুরস্কার ও তিরস্কার মিলে যাচ্ছে একই লোকের ভাগ্যে– পুরস্কারের নামে হচ্ছেন হেনস্তার শিকার। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিদায় নেওয়া সরকারের সময়ও এমনটা ঘটেছিল, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও ঘটল কাণ্ডটা।
আমাদের দেশে দুয়েকজন কীর্তিমান মানুষ আছেন, যারা একুশে বা স্বাধীনতা পদকের মতো জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন রীতিমতন জবরদস্তি করে। পুরস্কার পাওয়ার অযোগ্যরা অনেকেই পুরস্কার পেয়েছেন তদবিরের জোরে। তদবির যে প্রকাশ্যে হয় না, বলাবাহুল্য।তবে পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করার পর বাতিল বা স্থগিত করাটা গণহেনস্তার সামিল।
বাংলা একাডেমি পুরস্কারকে জাতীয় পুরস্কার বলা না হলেও এর একটা জাতীয় মর্যাদা আছে। এটা মূলত সাহিত্য পুরস্কার, কেউ কবিতায়, কেউ কথাসাহিত্য, কেউ আবার নাটক ও নাট্যসাহিত্যে অবদানের জন্য পুরস্কার পান।পুরস্কারের তালিকায় শিশু সাহিত্য, লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ, অনুবাদ, বিজ্ঞান, গবেষণা, প্রবন্ধ-গদ্য ইত্যাদি রয়েছে।
এবার ২০২৪ সালের পুরস্কারের জন্য ১০ জনের নাম ঘোষিত হয়েছিল। পরে ঘোষিত পুরো তালিকাটিই স্থগিত করা হয়েছে। এর আগে পুরস্কার পেয়ে প্রত্যাখানের ঘটনা ঘটেছে, এরশাদ সরকারের শাসনামলে নাট্যকার মামুনুর রশীদ বাংলা একাডেমির পুরস্কার প্রত্যাখান করেছিলেন, গত বছরই এক যুগ আগে পাওয়া পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে ব্যাপক আলোচিত হন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার।এবারও স্থগিত হওয়া তালিকায় কথাসাহিত্যে পুরস্কারের জন্য স্থান পাওয়া সেলিম মোরশেদ পুরস্কার প্রত্যাখানের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। পুরস্কার প্রত্যাখানের উদাহরণ থাকলেও পুরস্কার দিয়ে পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনা বিরল। একটি ঘটনা আছে স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে। এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ স্বাধীনতা পদকের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০২০ সালে। প্রবল সমালোচনার মুখে সেটি ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বাংলা একাডেমির পুরস্কার নিয়ে এমনটা আগে আর ঘটেনি।
এই তো এক বছর আগেও পুরস্কারটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। অভিযোগ ওঠেছিল, একজন তরুণকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য রীতিমতন পুরস্কার নীতিমালা সংশোধন করা হয়েছে। পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের হাতে অগাধ ক্ষমতা রয়েছে, সেটি ব্যবহার করে গত বছর অগাস্টে নাটক ক্যাটাগরির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল সাহিত্যনির্ভর আর্টফিল্ম বা নান্দনিক চলচ্চিত্রকে।
পৃথিবীর সব দেশেই পুরস্কার দেওয়ার রীতি আছে, তাই এই নিয়ে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। যারা পুরস্কার পান তারা নিজেদের সাধনা ও অবদানের জন্য পুরষ্কৃত হন। পুরস্কৃত হলে পত্রিকায় ছবি ছাপা হবে তাদের, কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা চলবে, কারো কারো সম্বন্ধে বড় বড় প্রবন্ধও ছাপা হবে। সেটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। তবে এই লেখা তাদের নিয়ে নয়, অন্য যারা পুরস্কার পেতে পেতেও হোঁচট খেয়ে পড়েন তাদের নিয়ে।
কেউ নাম কুড়িয়েছেন, কিন্তু পুরস্কার জিনিসটা তাদেরকে সবসময় বিবেচনার বাইরে রেখেছে– একসময় তাদের কাজ আলো ছড়িয়েছে, তারা পুরস্কারের উর্ধ্বে উঠে গেছেন। জীবদ্দশায় নিশ্চয় তাদেরকে প্রশ্ন শুনতে হয়েছিল, কোথায় তোমার পুরস্কার? তারা গলায় মালা পাননি সত্য, তবে তাদেরকে তা নিয়ে বিড়ম্বিতও হতে হয়নি।
বিড়ম্বিত হতে হয় তাদের, যারা গলায় মালা পেয়েও তা সঙ্গে সঙ্গে ছিনিয়ে নেয়া হয় নানান কারণ দেখিয়ে। একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার– আরো পুরস্কার হয়তো থাকতে পারে, যেমন শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থগার। কে পাচ্ছেন পুরস্কার সেটা বড় কথা নয়, হৈ চৈ হচ্ছে– কে পেয়েও পাচ্ছেন না পুরস্কার, তা নিয়ে। তার কার্যবৃত্তান্ত ও তার পারিবারিক ইতিহাস খতিয়ে দেখা হবে। কার সঙ্গে তার ছবি আছে, কোথায় তার কি বিবৃতি ছিল, সবই ফেসবুক ও পত্রিকায় লেখা হবে। কেউ কেউ আবার পুরস্কার বাতিলের দাবি জানিয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন রাস্তায়, বাংলা একাডেমি চত্বরে।তারপর ক্ষমতাবানেরা সিদ্ধান্ত নেবেন, তার নাম কেটে দেওয়া হবে কিনা। তিনি কারো চোখে নিন্দিত, আবার কারো চোখে নন্দিত।
বাংলা একাডেমির স্থগিত হওয়া পুরস্কার, আবার ঘোষিত হলে কয়েক জনের যে নাম কাটা পড়বে এটা সন্দেহাতীত।শেষ পর্যন্ত যারা তাদেরকে ‘নিন্দিত’ ভাবেন, তারাই জয়লাভ করবেন। তার বা তাদের পুরস্কার বাতিল করে নতুন নামের তালিকা ঘোষণা করা হবে। আর যার বা যাদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে, তার প্রাপ্তিও নেহায়েত কম হবে না।তিনি বা তারা পেয়ে যাবেন জাতীয় ‘হেনস্তা পুরস্কার’। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদেরকে এড়িয়ে চলতে হবে, নিজ স্ত্রীর কাছেও কিছুদিন কাঁচুমাচু থাকতে হবে, মনস্তাত্ত্বিক বিদ্যা না পড়েও তা বলে দেওয়া যায়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে, হেনস্তা তো আরো বেশি। হয়তো দেয়ালে পড়ে যাবে চিকা। বিভাগে ছাত্রদের ক্লাস বয়কটের হুমকি পাবেন। পুরস্কারটা তিনি হয়তো চাননি বা কোনো তদবির করেননি, তবুও কারা যেন নামটা দিয়ে দিল, পরিণতিতে এখন এত হেনস্তা।