রাজনীতির বিকল্প সন্ধানে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা
জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট) সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা দখলের জন্য শ্রীলঙ্কায় দুইবার (১৯৭১ ও ১৯৮৭-৮৯) সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিল। এই বিদ্রোহে তাদের দলের মূল নেতা রোহানা উইজেভরাসহ ৪০ হাজার নেতা-কর্মীসহ প্রায় ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এই হঠকারী রাজনীতির কারণে দেশটিতে তাদের প্রচণ্ড সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। এই ভ্রান্তনীতির পর তারা আত্মসমালোচনা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরে আসে। নিজেদের ভুলের জন্য জনগণের কাছে বারবার হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছে, তাদের আত্মোপলব্ধি ও অনুশোচনা প্রকাশ করেছে। জনগণও তাদের নিরাশ করেনি।
২০১৯ সালে জেভিপির নেতৃত্বে ২১টি সংগঠন নিয়ে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) গঠিত হয়। এই জোটে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ-সংগঠন যুক্ত। তাদের নির্বাচনী প্রতীক ছিল কম্পাস। ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কার অভ্যুত্থানের সময় এনপিপি তাদের জনসমর্থন বৃদ্ধি করে। ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এনপিপি প্রার্থী অনুঢ়া কুমারা দিশানায়েকে ৫৫.৮৯% ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট হন। মাত্র ৩টি আসন থেকে ২০২৪-এর সংসদ নির্বাচনে ২২৫টি আসনের মধ্যে তারা ১৫৯টি আসন অর্জন করে। তাদের এই উদাহরণ কি বাংলাদেশের বাম দলগুলোর জন্য অনুকরণীয় নয়?
শুধু রাজনৈতিক দল নয়, প্রয়োজন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জোট
বাংলাদেশে জোটচর্চার যে ধারা আছে তা থেকে বামপন্থীদের বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলের বাইরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, সমাজ-সম্প্রদায়, সংগঠন নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক জোট গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে সমাজের পরিবর্তনকামী সব অংশকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা যায়। এর মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন, পরিবেশবাদী, শিক্ষক, আদিবাসী, উপজাতি এমনকি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সংগঠনও যুক্ত হতে পারে। এই ধারার চর্চা বাংলাদেশের জন্য অভিনব হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা আছে। শ্রীলঙ্কায় বামপন্থীদের ক্ষমতায়নে এই কৌশল সাফল্য দিয়েছে।
বামদের পুনর্মিলন প্রয়োজন
স্বার্থ-সুবিধার নানা কারণ-সমীকরণে কিছু বাম দল ও নেতা লুটেরাদের উচ্ছিষ্টভোগী এবং ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে। কিন্তু সে কারণে তাদের মূল্যও কম দিতে হয়নি। দলে ভাঙন হয়েছে, তাদের সম্মান-মর্যাদাও বহুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের কারণে অন্য বাম দলের ভাবমূর্তিও ক্ষতির মুখে পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা যদি তাদের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নতুন করে মানুষের স্বার্থের পক্ষে কাজ করতে চায়, তাদেরও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বৃহত্তর ঐক্যের অংশীদার হওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবতে হবে। তাদের রাজনীতি থেকে ঝরে পড়া, ছিটকে পড়া, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া অংশকে হয়তো রাজনীতিতে পুনরায় যুক্ত করা যাবে।
জাতীয় পর্যায়ে আমরা পুনর্মিলনের (রিকনসিলিয়েশন) কথা বলি, কিন্তু একই আদর্শের (?) বলয়ের ক্ষেত্রে কেন সে কথা বলি না বা ভাবছি না? নিজেদের বিচ্ছিন্নতা প্রতিপক্ষকে শক্তিশালী করবে। মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানের বাইরে ৭২-এর সংবিধান (অগণতান্ত্রিক অসংগতি বাদে) মুক্তিযুদ্ধের মূল স্পিরিট হতে পারে বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তি। এ ক্ষেত্রে সংকট হচ্ছে একই নামের ব্র্যাকেটবন্দী বিভিন্ন দল একে অন্যের বিষয়ে আপত্তি জানাবে কিন্তু বর্তমান জরুরি পরিস্থিতির কর্তব্য বিবেচনায় উদারতার পরিচয় দিতে হবে। ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতাসীন হলে তা কারও জন্যই সুখের ও স্বস্তিকর হবে না।