
বিএনপি–জামায়াত বিরোধ কেন, কত দূর যাবে
জুলাই–আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে গত পাঁচ মাসে বেশ কিছু বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। দল দুটির এই বিরোধ আগামী দিনের রাজনীতি ও নির্বাচন ঘিরে কত দূর গড়াবে, এর পরিণতি কী—এসব নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা বিতর্ক ও বিশ্লেষণ চলছে। গত কয়েক মাসে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দল দুটির সম্পর্কের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হতে পারে।
প্রায় ২২ বছরের রাজনৈতিক মিত্র ও নির্বাচনী সঙ্গী দুটি দল—বিএনপি ও জামায়াত। সে সম্পর্ক এখন অতীত। ২০২২ সালে দল দুটির সম্পর্ক শিথিল হয় ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন বিএনপি ও জামায়াত পরস্পর বিরোধপূর্ণ একটি জায়গায় আবির্ভূত হচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি দল দুটিকে প্রতিপক্ষের জায়গায় এনেছে। তাঁরা বলছেন, কাছাকাছি ভাবধারার দুটি দলের মধ্যে ভোটের মাঠে জামায়াতের অবস্থান যতই শক্ত হবে, বিএনপির সঙ্গে বিরোধের জায়গাটাও তত শক্ত হবে। কেউ কেউ এটাকে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও পলায়ন–পরবর্তী প্রেক্ষাপটে একটি নতুন রাজনৈতিক গতিপথের নির্দেশ হিসেবেও দেখছেন।
মুক্তিযুদ্ধ, বিএনপি ও জামায়াত
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর জামায়াতের আমিরের কিছু বক্তব্য ও বিএনপির নেতৃত্বের বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা–সার্বোভৌমত্বের প্রশ্নে ‘নিরাপদ’ অবস্থানে থেকে ভবিষ্যৎ রাজনীতির পথনির্দেশ দিচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মীদের একটি অংশের মূল্যায়ন হচ্ছে, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব একটি বিষয়ে খুব তৎপর। সেটি হচ্ছে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া। এটাকে অনেকে চব্বিশ দিয়ে একাত্তরকে ‘চাপা দেওয়া’ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের ভূমিকা আড়ালে নেওয়ার চেষ্টা হিসেবেও দেখছেন।
জামায়াতের নেতারা যদিও বলছেন, বিষয়টিকে তাঁরা এভাবে দেখেন না; তাঁরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ হিসেবেই দেখেন। তবে জামায়াতের সাম্প্রতিক তৎপরতায় অনেকটা স্পষ্ট যে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী প্রেক্ষাপটে দলটির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষের বিভক্তিরেখা ভেঙে দিয়ে রাজনীতিতে একটি সমান্তরাল অবস্থান তৈরি করা। কারণ, বিগত দিনগুলোয় আওয়ামী লীগ ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি’ বলে জামায়াতকে ঘায়েল করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকা আড়াল করার চেষ্টা যে সহজ হবে না, তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। খোদ বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারাই একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা সামনে এনেছেন। তাঁরা জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী ‘রাজাকার’ বলে সমালোচনাও করেছেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর পর এ বিষয়ে কথা বলেছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ।
৯ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় হাফিজ উদ্দিন আহমদ জামায়াত আমিরের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের বিষয় উল্লেখ করে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘এখন একটা সুযোগ এসেছে, এই সুযোগে তারা (জামায়াতে ইসলামী) একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। সেটি না করে তারা একাত্তরে তাদের ভূমিকাকে জাস্টিফাই (জায়েজ) করার চেষ্টা করছে।’
বিষয়টি নিয়ে জামায়াতের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয়। তাতে প্রতীয়মান হয়, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন করে বিএনপির নেতাদের এই চর্চা তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে জামায়াত সম্পর্কে বিএনপির কয়েকজন নেতার সাম্প্রতিক বক্তব্যকে ‘দলীয় অবস্থান’ মনে করছেন না জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।