বিদেশি বিনিয়োগ টানতে বাংলাদেশ কেন ব্যর্থ হচ্ছে
বাংলাদেশের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি যখন চিন্তা করেন উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে কি জমি কিনবেন, উচ্চ হারে ফিক্সড ডিপোজিট করবেন, নাকি শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ করবেন, তখন তাঁর মনে কী কী বিবেচনা কাজ করে? তেমনটি দুবাই, সিঙ্গাপুর, মুম্বাই, কুয়ালালামপুর, লন্ডন, প্যারিস বা নিউইয়র্কে যখন কোনো কোম্পানি বা ধনকুবের তাঁর বা তাঁদের পুঁজির নতুন বিনিয়োগ–গন্তব্য বেছে নিতে চান, তখন কী কী বিষয় বিবেচনায় নেন?
৩৫ বছরের বেশি সময় দেশে–বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগানো বা ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে, ব্যবসায়ীরা পত্রপত্রিকা পড়ে নয়, বরং ইতিমধ্যে ব্যবসা করছেন—এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তারপর আসে পুঁজি এনে বা বিনিয়োগে লাভের সম্ভাবনা, আর্থিক খাতের গভীরতা আর ব্যাংকঋণ পাওয়ার সহজলভ্যতা, দক্ষ শ্রমিক বা ব্যবস্থাপক পাওয়ার সুবিধা, যাতায়াত বা পরিবহন অবকাঠামো, মুনাফা বাইরে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা, প্রচলিত আইনি কাঠামো আর দুষ্ট প্রভাবমুক্ত বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা এবং দুর্নীতির প্রকোপ থেকে দূরে থাকতে পারার সুযোগ। সেই সঙ্গে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও ভোক্তা ব্যয়ের রকমফেরও বিবেচ্য হয়ে থাকে।
সেই স্নাতক পর্যায় থেকে শুনে আসছি, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে এবং কর্মসংস্থান প্রসারে নতুন নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সৃষ্টি প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে বিনিয়োগ তথা বিদেশি বিনিয়োগ। কোনো দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার অর্থ হচ্ছে তাদের উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ আছে এবং সেখানে ব্যবসা লাভজনক। কিন্তু বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সফলতা নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের আকর্ষণীয় গন্তব্য বলা হলেও বিনিয়োগের পরিবেশের বিষয়টি শুধু আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ। বিদেশিদের আকর্ষণে নানামুখী নীতি প্রণয়ন হলেও এর ধারাবাহিকতা নেই। বিনিয়োগের উপযোগী হিসেবে আস্থা অর্জন থেকেও বারবার ছিটকে পড়তে হয়েছে দেশকে। আবার বিনিয়োগ ধরে রাখতে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রতা ও সমন্বয়হীনতা, তা দূর হয়নি গত তিন দশকে। সব মিলিয়ে হাতে গোনা দু-একটি কোম্পানি ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগের বড় সফলতা পায়নি এ দেশ।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, ভোগব্যয় বৃদ্ধি আর অধিক হারে মধ্যবিত্তের বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় বা সম্ভাবনাময় এক বাজার হতে পারে বাংলাদেশ। তারপরও দেশে বড় আকারে বিনিয়োগ আকৃষ্ট না হওয়ার কারণ অভ্যন্তরীণ। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগনীতির ধারাবাহিকতার অভাব, অর্থাৎ বছর বছর বিনিয়োগনীতির পরিবর্তন, বিনিয়োগে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সক্ষমতার অভাব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এই বিনিয়োগ–স্বল্পতার পেছনে কাজ করেছে।
এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো এখনো কোনো কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক রূপান্তরে সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)। আশির দশক–পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে অবদান রেখেছে এফডিআই। বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে এফডিআই।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিদেশি বিনিয়োগ