
রাজনীতিতে পুরোনো ধারা নাকি নতুন শক্তির উত্থান?
বাংলাদেশ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক গভীর রাজনৈতিক মোড় পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে গেছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসান, সরকারপ্রধানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দেশত্যাগ, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আবির্ভাব এবং সর্বোপরি তরুণ-নেতৃত্বাধীন এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার উত্থান—এসবই ছিল অভূতপূর্ব। কিন্তু এসব পরিবর্তনের পরে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র একদিকে শূন্য হলেও অন্যদিকে নতুন করে বিভিন্ন শক্তির মধ্যে অবস্থান নিশ্চিত করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের নীতি, অর্থনৈতিক ধারা, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং সম্ভাব্য বিকল্প শক্তির উত্থান নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নেতৃত্বাধীন প্রশাসন একদিকে সংস্কারমুখী রাজনীতির বার্তা দেয়, অন্যদিকে নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে ঘিরে একটি দীর্ঘ অনিশ্চয়তার ছায়া তৈরি করে। তিনি জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানান, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও বিচারিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেন, কিন্তু স্পষ্টভাবে কোনো রাজনৈতিক দলকে আশ্রয় বা প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরেননি। তার এ অবস্থান একদিকে যেমন বহু মানুষের মধ্যে স্বস্তি জাগায়, অন্যদিকে রাজনৈতিক মেরুকরণের বাস্তবতায় এই নিরপেক্ষতার বার্তা অনেকের চোখে ধোঁয়াশাপূর্ণ বলে মনে হয়। কারণ, যিনি দেশের দায়িত্বে আছেন, তার অবস্থান যদি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বে ‘অরাজনৈতিক’ হয়, তাহলে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য কাকে কীভাবে গ্রহণযোগ্য করবেন, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
এদিকে ড. ইউনূসের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও নানান সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তার ‘গ্রামীণ মডেল’, যা এক সময় দারিদ্র্য বিমোচনের প্রতীক ছিল—তাকে দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার যে চেষ্টা এখন চলছে, তা অনেক সময় বাস্তব ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় ঠেকে যাচ্ছে। জনগণের মধ্যে দারিদ্র্য, মূল্যস্ফীতি এবং চাকরি সংকট—এই ত্রিমুখী চাপ ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ এবং গ্রামীণ ব্যাংকধারার মাইক্রোফাইন্যান্স পদ্ধতি এখন আর আগের মতো একরৈখিক কার্যকর নয়। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে যে নতুন দিশা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, তা এখনো বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য হয়ে ওঠেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি যেন এক মিশ্র জগৎ—যেখানে কিছুটা দারিদ্র্য বিমোচন, কিছুটা স্বপ্নের অর্থনীতি, কিন্তু বাস্তব জীবন অনেক বেশি জটিল এবং বৈষম্যময়।
জুলাই-পরবর্তী সময়ই দেখা যাচ্ছে—অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। সামগ্রিক আয়-বণ্টনের বৈষম্য, প্রবাসী আয়নির্ভরতার সমস্যা, কৃষিখাতের উপেক্ষা এবং মধ্যবিত্তের আস্থা সংকট—এসব মিলিয়ে এখন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো একটি চূড়ান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। অন্তর্বর্তী সরকার যদিও কর কাঠামো সংস্কার এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু সাধারণ জনগণ বিশেষত তরুণরা সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সুফল দেখতে পাচ্ছে না। কর্মসংস্থানের সংকট দূর না হলে কিংবা শিক্ষা-বাজারের সঙ্গে শ্রমবাজারের সম্পর্ক নতুন করে গঠন না করা গেলে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের আস্থার ফাঁক আরও গভীর হবে।
ড. ইউনূস নিজেকে এখনো নির্বাচনের বাইরে রাখার ঘোষণা দিয়ে থাকলেও লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠক এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান এই বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে সম্মত হন। তিনি নির্বাচনকালীন সরকার ও ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নিয়ে আলোচনা করেন। এ বৈঠক নিয়ে জনগণের মধ্যে দুই রকম প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কেউ মনে করেন, এটি একটি রাজনৈতিক পরিপক্বতার সূচনা, যেখানে ক্ষমতার হস্তান্তর একটি সমঝোতার মধ্য দিয়ে হতে পারে। আবার কেউ মনে করেন, এটি একধরনের ব্যাকচ্যানেল ডিল, যেখানে গণজাগরণের পুঁজি দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই সংলাপ ও সমঝোতার মধ্যেই উঠে আসে আরও একটি প্রশ্ন—ড. ইউনূস কি শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে প্রবেশ করতে চাইছেন, নাকি তিনি শুধুই একটি অস্থায়ী স্থিতিশীলতার ভার বহন করছেন? এই প্রশ্নটির জবাব এখনো অনির্দিষ্ট। তার আশেপাশে থাকা পরামর্শদাতাদের মধ্যে কেউ কেউ চাচ্ছেন, ড. ইউনূস একটি নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ুন, কেউ আবার বলছেন, তিনি তার অবস্থানে থেকেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরি করুন। কিন্তু যেহেতু তার ব্যক্তিত্ব বহুল পরিচিত এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সম্মানিত, তাই তার কোনো সিদ্ধান্তই শুধু ব্যক্তিগত থাকবে না—তা রাষ্ট্র এবং রাজনীতির ভবিষ্যৎ প্রভাবিত করবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাংলাদেশের রাজনীতি