কোটা আন্দোলন: সাহসের সমাচার
এক.
বাংলাদেশে শাসকরা যখনই নিশ্চিন্ত হন যে, তাদের অনির্দিষ্টকাল রাষ্ট্রশাসনের ভবিষৎ নিষ্কন্টক, ঠিক ওই সময়টাতে হঠাৎ একটা কিছু ঘটে যায়। শাসকদের শান্তির রাজত্বে কোনো এক অভিঘাত সবকিছু ওলোট-পালট করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর বাকশালের নিশ্চয়তা হয়ে গেল রক্তক্ষয়ী সর্বনাশ, জিয়াউর রহমানের নির্বিঘ্ন শাসন শেষ হলো প্রাণক্ষয়ে, এরশাদের গদি ভাঙল তার প্রণয় ও কবিতায় জনগণের বিতৃষ্ণায়, বেগম জিয়ার শাসন খাটো হলো একজন বিচারকের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর মধ্য দিয়ে এবং সর্বশেষ হাসিনার লৌহকপাট ভাঙল কোটা আন্দোলন নিয়ে অতি চালাকিতে। হয়তোবা কারণগুলো উপলক্ষ মাত্র, কিন্তু পতনগুলো ছিল অনিবার্য।
কোটা আন্দোলন ও শেখ হাসিনার পতন নিয়ে এদেশে আলোচনা হবে অনেক। হাসিনার পরাজয় যেমন নাটকীয়, এদেশের কোটা আন্দোলনের ইতিহাসও তেমনি গৌরবময়। আন্দোলনের পুরো সময় জুড়ে ১৫ জুলাই ২০২৪ দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন তখনও প্রাথমিক অবস্থায়। তরুণ সমাজ আন্দোলনের সাফল্য নিয়ে দোদুল্যমান। ওই সময় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ২৫ বছরের আবু সাঈদ এগিয়ে এলেন তার সাহসের সমাচার জানান দিতে। অন্যরা যখন পিছিয়ে পড়েছেন, আবু সাঈদ প্রসারিত বুক চেতিয়ে দাঁড়ালেন মিছিলের সম্মুখে। বন্দুক তাক করে রাস্তার ওপারে অবস্থান নিলো পুলিশ। পুলিশি রক্তচক্ষুকে তাচ্ছিল্য করে, আবু সাঈদ তার বুকের পাঁজরের কাঠামো আরও শক্ত করে দুই হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন পুলিশের বন্দুকের সামনে।
স্বৈরাচারের পুলিশ আবু সাঈদের সাহস দেখে আরও ক্রোধান্বিত হলো। দুজন পুলিশ অফিসার ১৫ মিটার দূর থেকে সোজা তার বুকে গুলি করল। আবু সাঈদের বুকটা নড়ে উঠল। আরও দুবার তাকে গুলি করা হলো। এরপর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। তার সহযোদ্ধারা এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
আবু সাঈদ পুলিশের ওপর কোনো আক্রমণ করেননি, তিনি শুধু দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। তার অপরাধ ছিল পুলিশের সামনে হাত ছড়িয়ে সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। কি নির্মম ও অপ্রয়োজনীয় ছিল এই মৃত্যু! কিংবা হয়তবা অনেক প্রয়োজনীয় ছিল আবু সাঈদের এই রক্তদান। আবু সাঈদের রক্তের স্রোতধারা এঁকে দিয়েছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পথনির্দেশনা।
আবু সাঈদের একজন শিক্ষক বলেছেন, “ছাত্র সবাই, তবে কিছু কিছু ছাত্র এমনভাবে মন জয় করে, তাদের ভোলা যায় না। তেমনি একজন ছাত্র ছিল আবু সাঈদ।” সত্যি, আবু সাঈদকে কখনো ভোলা যাবে না। আবু সাঈদের বাবা একজন দিনমজুর। আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামের লোকজনদের সহায়তা নিয়ে বাবা তার লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। আবু সাঈদ শেষদিন পর্যন্ত সেটা ভোলেননি, নিজের রক্ত দিয়ে ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখলেন রংপুরের পীরগঞ্জের মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের নাম। তিনি যখন দুই হাত ছড়িয়ে বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে হয়তো দীপ্ত স্বরে বলেছিলেন, আমাকে যারা পাঠিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, এই প্রতিদান তাদের জন্য, এই প্রতিদান দেশের জন্য, এই রক্ত রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।
আবু সাঈদ ছিলেন একজন সাহসী বীর, তিনি জানতেন এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হলে পিছিয়ে পড়লে চলবে না। তাই তো তিনি তার সাহসের সমাচার জানিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন। তার সাহসের সমাচার এবং যুদ্ধের বীরত্ব অন্যদের মাঝেও অনুরণনিত হলো। তারাও সাহসের সমাচার জানিয়ে মিছিলের সামনে এগিয়ে আসলেন প্রতিদিন, যতদিন স্বৈরাচারের বন্দুকের আওয়াজ স্তব্ধ না হলো। এইভাবে অসংখ্য আবু সাঈদ বুকের রক্ত দিয়ে গড়ে গেলেন ইতিহাস, তাদের অনেকের নাম আমরা জানি—ফারুক, ওয়াসিম, তাহির, ফাহমিন, শাহজাহান, দীপ্ত, নাফিসা আরও অনেক নাম, আবার অনেকের নাম আমরা জানি না।
দুই.
আবু সাঈদ ও তার অসংখ্য সতীর্থ কোথা থেকে শিখলেন এই আত্মত্যাগ? বাংলাদেশের জন্য এটা নতুন কিছু নয়। তাদের পূর্বসূরিরাও স্বৈরাচারের সঙ্গে কোনোদিন আপোস করেননি। ভাষা নিয়ে, স্বাধিকার নিয়ে ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন এবং জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। এই জয় যেদিন থেমে যাবে, ওইদিন আমাদের দেশও থেমে যাবে এবং আমরা ফুরিয়ে যাব।
তিন.
বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ বিভিন্ন কোটাতে বিলি-বল্টন হয় আর বাকি ৪৪ শতাংশ চাকরির জন্য দেশের অগুণতি তরুণকে প্রতিযোগিতা করতে হতো। ওই প্রতিযোগিতা ক্রমান্বয়ে অসহনীয় হয়ে পড়ে, কারণ প্রতিবছরই নতুন ডিগ্রিধারীরা চাকরি না পেয়ে বেকারের দল ভারী করছিল। সরকারি কোটার ১০ শতাংশ ছিল নারীদের জন্য, ১০ শতাংশ ছিল অনগ্রসর এলাকার জনগণের জন্য, ৫ শতাং সংখ্যালঘু আদিবাসীদের এবং বাকি ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান ও নাতি-পুতিদের জন্য বরাদ্দ। এমনিতেই শেখ হাসিনার শাসনকালের পুরোটা সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি করার প্রবণতা জনগণের মনে দারুণ ক্রোধের জন্ম দিয়েছিল, কোটা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-পুতিদেরক চাকরি নিশ্চিত করার চেষ্টা সঙ্গতকারণেই তরুণ সমাজ তাদেরকে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করার কলকাঠি হিসেবে দেখল।
২০১৮ সালের ২১ মার্চ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের পাশাপাশি নাতি-নাতনিদের জন্যও প্রযোজ্য হবে বলে যখন ঘোষণা দিলেন, তখন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ জানাল। ৮ এপ্রিল থেকে শুরু হলো আন্দোলন ও প্রতিবাদ। ছাত্রলীগের লাঠিয়াল বাহিনী কোটা আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন স্থানে মারধর করে আন্দোলনকে প্রতিহিত করতে চেষ্টা করল। ডাকসুর তৎকালীন ভিপি নুরুল হক নুর ছিলেন তাদের মারধরের সবচেয়ে বড় টার্গেট। শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারবর্গের কোটা নিয়ে তিনি কোনো আপস করবেন না। আন্দোলন চলতেই থাকল, ধীরে আরও গতি পেল।