রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে কি

কালের কণ্ঠ ড. ফরিদুল আলম প্রকাশিত: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২৭

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনকালীন প্রচারণায় বলেছিলেন, বিজয়ী হলে তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন এবং কিভাবে তা করবেন, সে সম্পর্কে তার নিখুঁত পরিকল্পনা রয়েছে, যদিও তার পরিকল্পনার বিস্তারিত তিনি প্রকাশ করেননি, তবে তার রানিং মেট জেডি ভেন্স এ ব্যাপারে সম্প্রতি ধারণা দিয়েছেন। ধারণাটি এ রকম—নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর ট্রাম্প রাশিয়া, ইউক্রেন এবং ইউরোপের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবেন। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে ইউক্রেনকে তার সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে, সেই সঙ্গে রাশিয়াকেও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া হবে। এই নিরাপত্তার গ্যারান্টি এ রকম হবে যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো ও ইউক্রেন কখনো রাশিয়ার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না এবং ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদান থেকে বিরত থাকবে।


সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, এ রকম ধারণা যদি কার্যকর হয় এবং এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয়, তাহলে এত দিন ধরে এই যুদ্ধ এবং ধ্বংসযজ্ঞের কী অর্থ দাঁড়াল? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ, ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করেছেন, সেই সঙ্গে এই যুদ্ধে মার্কিনদের পক্ষ থেকে দেওয়া অর্থ এবং অস্ত্রের জোগান নিয়েও তিনি বরাবরই সমালোচনামুখর ছিলেন। তবে এই যুদ্ধের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়া ও ইউক্রেন—উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত, বিশেষ করে দুই পক্ষই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেনা সদস্য হারিয়েছে এবং রাশিয়া ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা নিজেদের দখলে নিয়েছে। এসব বিবেচনায় নিলে প্রায় তিন বছর ধরে চলমান একটি যুদ্ধ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধ শুরুর পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে, এটি ভাবা বোধ হয় খুব একটা সহজ বিষয় নয়। বিষয়টি আসলে বিগত প্রায় তিন বছরে অনেক জটিল হয়ে গেছে।

আর এই জটিলতার নেপথ্যে কাজ করেছে বাইডেন প্রশাসন। এই সময়ের মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোতে গচ্ছিত রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে, তাদের অর্থের একটি বড় অংশ ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের খরচ হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ কিছু দেশের তৈরি অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনের মাধ্যমে রুশ ভূখণ্ডে আঘাত করা হয়েছে। এককথায় এসব হিসাব চুকানোর বিষয় রয়েছে। এগুলোর নিষ্পত্তির সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ বা যুদ্ধবিরতি সম্পৃক্ত।


ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার পর কিছুটা নড়েচড়ে বসেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ও পুতিন। তারা দুজনই যুদ্ধ বন্ধ প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করতে চাইছেন। এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাম্প্রতিক বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শর্তহীনভাবেই ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনের নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় বসতে তার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। তবে এখানে শর্তহীন হলেও শর্ত জুড়ে দিয়েছেন এই বলে যে আলোচনায় বসলেও রাশিয়া ইউক্রেনের বৈধ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করতে চায়।




এ কথা বলার কারণ হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে এবং যুদ্ধের কারণে নির্বাচন স্থগিত করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে রাশিয়ার অধিকৃত ভূমি ইউক্রেনকে ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে যেকোনো যুদ্ধ বন্ধের চুক্তির বিষয়টি তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। কম যাচ্ছে না ইউক্রেনও। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাশিয়াকে সমস্ত অধিকৃত ভূখণ্ড, এমনকি ২০১৪ সালে দখলে নেওয়া ক্রিমিয়া ইউক্রেনের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে; এর ব্যত্যয় হলে তারা যুদ্ধ বন্ধের কোনো চুক্তিতে রাজি হবে না। এই অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ফর্মুলা নিয়ে যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে অগ্রসর হতে চাইছেন, সেটি কার্যকর হওয়া নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।


সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ায় সরকার পতনের বিষয়টি প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে নতুন করে চাঙ্গা করেছে এই কারণে যে এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার আধিপত্য খর্ব হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরেও এর প্রভাব পড়বে। এটি নিঃসন্দেহে রাশিয়ার সঙ্গে শক্তির প্রতিযোগিতায় পশ্চিমা বিশ্বের একটি বড় জয়। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিষয়ে পশ্চিমা সম্প্রদায় যে উদ্দেশ্যে ইউক্রেনকে সহযোগিতা শুরু করেছিল, সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার সেনাদের নৈতিক মনোবলের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবে। এটিকে আসলে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়—প্রথমত, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার অধিক মনোযোগের কারণে সিরিয়া থেকে তাদের মনোযোগ সরে এসেছে; দ্বিতীয়ত, রাশিয়া সত্যিকার অর্থেই ইউক্রেন ও সিরিয়া—এই দুই জায়গায় তাদের সমান মনোযোগ দিতে গিয়ে আসলে কোনোখানেই সেভাবে সফল হতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া থেকে তাদের পিছুটান ইউক্রেন যুদ্ধেও তাদের নিরাশ করে থাকতে পারে। আর সে কারণেই প্রেসিডেন্ট পুতিন ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় বসার বিষয়ে তার আগ্রহের বিষয়টি জানান দিয়েছেন।


কারণ যা-ই থাকুক না কেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিঃসন্দেহে বিশ্বের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব যদি এভাবেই ইউক্রেনকে মদদ দিয়ে যেতে থাকে, তাহলে রাশিয়াও যেভাবে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, সেভাবেই এই যুদ্ধ চলতে থাকবে। এভাবে হয়তো আরো কয়েক বছর কেটে যাবে। এর ফলে যা হবে, তা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হবে, একই রকম অবস্থা হবে রাশিয়ার। সুতরাং তুলনামূলক লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় না গিয়ে সবার মঙ্গলের স্বার্থেই এই যুদ্ধের একটা ইতি টানা জরুরি। এখন দেখা যেতে পারে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে আর কী কী বিকল্প থাকতে পারে, যা দিয়ে তিনি এই যুদ্ধ বন্ধে তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সফল করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রথমত দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নির্বাহী আদেশে ইউক্রেনকে মার্কিন অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারেন। আমরা জানি, এ পর্যন্ত পশ্চিমা সহায়তার অর্ধেকের বেশির জোগান এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। সুতরাং ইউরোপের দেশগুলোর পক্ষে মার্কিন সহায়তা ছাড়া এককভাবে ইউক্রেনকে সহায়তা দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এটি নিশ্চিত যে ট্রাম্প এটিই করবেন। এ ক্ষেত্রে জেলেনস্কির পক্ষে রাশিয়ার আক্রমণ সামাল দেওয়া খুবই কঠিন। এর ফলে রাশিয়া হয়তো আরো মারমুখী হয়ে ইউক্রেনের অবশিষ্ট অঞ্চলগুলো এবং রাজধানীর কিয়েভকে তাদের লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। এমনটি হলে রাশিয়ার স্পষ্টতই বিজয় হবে। এটিও নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্র এবং অপরাপর পশ্চিমা সম্প্রদায় প্রত্যাশা করবে না। সে ক্ষেত্রে তাদের দিক থেকে চাওয়া থাকবে এর যেন একটি শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হয়।


এ ক্ষেত্রে এই যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার বিষয়টি নির্ভর করবে কূটনৈতিকভাবে রাশিয়াকে কতটুকু নিবৃত্ত করা যায় তার ওপর। সত্যি কথা বলতে গেলে বিরাজমান অবস্থায় এই যুদ্ধ শেষ করতে গেলে রাশিয়ার কিছু দাবি মেনে নিয়েই যদি তা করতে হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে অধিগ্রহণ প্রশ্নে গোটা বিশ্বকে যেমন নীরব থাকতে হয়েছিল, ইউক্রেনের ভূখণ্ডের কিছু দাবীকৃত এলাকাও তেমনি রাশিয়াকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া সফল হওয়ার সুযোগ সীমিত। এ কথাও ঠিক যে এই যুদ্ধে রাশিয়াও অনেক বিপর্যস্ত, তবে এখানে তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি যে তিনি এই যুদ্ধ বন্ধ করবেন। এটি না করে এই যুদ্ধে নতুন করে মার্কিন অর্থলগ্নি ট্রাম্পকে জনগণের কাছে আরো সমালোচিত করবে। সুতরাং ট্রাম্পকে এই যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে আলোচনাকে তার দায়িত্ব গ্রহণের পর সর্বাগ্রে স্থান দিতেই হবে। মাত্র কিছুদিন আগে মার্কিন অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালানো ইউক্রেন ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর যে আর কোনো মার্কিন অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারবে না, সেটি প্রায় নিশ্চিত।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও