নগদ প্রণোদনা ও কর-শুল্ক ছাড় কেন বন্ধ হওয়া প্রয়োজন
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ গোড়া থেকেই বাণিজ্য ঘাটতির দেশ। আর এ ঘাটতি পূরণে সব সরকারই আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে বলে তাদের প্রত্যেকের দাবি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে উল্লিখিত বাণিজ্য ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, সেসব উদ্যোগের ফলে রফতানি আয় যতটা বেড়েছে, সে তুলনায় রফতানির অছিলায় রফতানিকারক কর্তৃক রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কর, শুল্ক ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা গ্রহণের হার বেড়েছে তার চেয়েও অধিক অযৌক্তিক হারে। বিভিন্ন পণ্য রফতানি করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছেন তার মধ্যে রয়েছে স্বল্প সুদের ঋণ, নগদ ভর্তুকি ও প্রণোদনা, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াত, কর অব্যাহতি, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ, রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এক. এতসব সুবিধার বিনিময়ে প্রকৃত রফতানি আয় কতটা বেড়েছে বা বাড়ছে? দুই. বৃদ্ধির সে পরিমাণ রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সুবিধার বিপরীতে যথেষ্ট কিনা? তিন. এ ধরনের অন্যায্য সুবিধাদানের ফলে রাষ্ট্র ও সমাজে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে কিনা।
উল্লিখিত প্রথম ও দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব একসঙ্গে দেয়ার সুবিধার্থে গোড়াতেই বলা যেতে পারে যে ১৯৯১ সাল থেকে বাজার অর্থনীতিতে পুরোপুরিভাবে যুক্ত হওয়ার পর থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত ৩৩ বছরের অধিকাংশ সময়জুড়েই বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মোটামুটি সন্তোষজনক। এমনকি কোনো কোনো বছর এ সন্তুষ্টির মাত্রা ছিল অনেকটাই বিস্ময়কর। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে এ হার ছিল ১৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে এসব বিস্ময়কর তথ্যের যথার্থতা নিয়ে পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সরবরাহকৃত ওই ৩৩ বছরের সব তথ্য নিয়েই কমবেশি প্রশ্ন রয়েছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন রয়েছে আ হ ম মুস্তফা কামালের সময়ে তার সক্রিয় উৎসাহে প্রণীত অতিরঞ্জিত তথ্যের বিষয়ে। এটি এখন প্রায় সর্বজনবিদিত যে তিনি ছিলেন বিবিএসের অধিকাংশ তথ্যের ক্ষেত্রেই বিকৃতি ঘটানোর ‘অমোঘ’ কারিগর, যেসব তিনি কখনো কমিয়ে দেখিয়েছেন আবার কখনো-বা বাড়িয়ে। আর এ ধরনের হ্রাস-বৃদ্ধির খেলারই ফলাফল হচ্ছে, উল্লিখিত সোয়া তিন দশকে রফতানি বাণিজ্যে প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার প্রায় কখনই অতটা ঝলমলে ছিল না, যতটা ঝলমলে করে বিবিএস তা দেখিয়েছে।
তৃতীয় প্রশ্নের জবাব কমবেশি প্রায় সবারই জানা; যা একই সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত, কষ্টদায়ক ও হতাশাব্যঞ্জকও। রফতানি বৃদ্ধির নাম করে বাজার অর্থনীতি যুগের উল্লিখিত ৩৩ বছরে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের যেসব অন্যায্য সুবিধা প্রদান করা হয়েছে, তাতে রাষ্ট্র ও সমাজে একদিকে যেমন ব্যাপক হারে সম্পদবৈষম্য বেড়েছে, অন্যদিকে তেমনি তা বাড়িয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তিকেও। এমনকি কখনো কখনো তা বড় মাত্রার নিষ্ঠুর আঙ্গিকের শোষণ-নিগ্রহেরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোট কথা, সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্র ও স্তরে বর্তমানে যে অমানবিক মাত্রার বৈষম্য বিরাজ করছে, তার পেছনে রফতানি বৃদ্ধির কথিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের প্রদত্ত আর্থিক প্রণোদনা ও সুবিধাদিরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তার আওতায় উল্লিখিত রফতানি প্রণোদনাগুলোর মধ্যকার কোনো কোনোটির বিলুপ্তি ও কোনো কোনোটির পুনর্বিন্যাসের বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। সমাজ থেকে বৈষম্য হ্রাস ও রাষ্ট্রকে যতটা সম্ভব জনগণের স্বার্থানুগামী করে তোলার লক্ষ্যে বিষয়টি এখন অনেকটাই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নগদ প্রণোদনা
- আমদানি শুল্ক ছাড়