সময় গেলে সাধন হবে না
জাতীয় বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে এখন জাতীয় সরকার, না জাতীয় নির্বাচন বেশি প্রয়োজন—এই বিতর্কটি ডিম আগে, না মুরগি আগের মতো না হলেও এটি একটি জটিল রাজনৈতিক প্রশ্ন। ইসকন কিংবা সনাতন জাগরণ মঞ্চ এবং বিশেষ করে মঞ্চের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা অভাবিত। এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলির জন্য বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কিংবা জনগণ—কেউই প্রস্তুত ছিল না। ব্রহ্মচারী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার এবং আইনজীবী সাইফুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে আকস্মিক একটি ভিন্ন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়।
এতে বর্তমান বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক সংকট নতুন করে যে কোনো হুমকির সামনে পড়েছে শুধু তা-ই নয়, এই সমস্যাসংকুল দেশটির সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে একটি গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের গণমাধ্যম এবং বিজেপি সরকারসহ প্রতিরক্ষা দপ্তর যেভাবে সীমাহীন প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছিল, তা বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি। কারণ ভারতের মতো বাংলাদেশে কখনোই সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের বিষয়টি মোটেও জটিল ছিল না। বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের কাছে কখনোই কোনো উদ্বেগের কারণ ছিল না।
সে ব্যাপারে সাম্প্রতিক ক্ষমতাসীন সরকার কোনো রাজনৈতিক ঘুঁটি চাললেও সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠী তা পছন্দ করেনি। কারণ তাদের মধ্যে সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু সংক্রান্ত কোনো সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয়ভাবে কাজ করেনি। সে অবস্থায় হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্যদের মধ্যে কোনো ক্ষোভের সৃষ্টি হলে সেটি ছিল বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা। তার দায়ভার অন্যরা কাঁধে তুলে নিতে রাজি হবে না।
সে কারণে সম্প্রতি চট্টগ্রামে যে সমস্ত অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেছে, তার জন্য সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ সাবেক ক্ষমতাসীন সরকার, তাদের দল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকেই দায়ী করছে। এবং সে প্রকৃত ঘটনার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ববাদী সরকার বাংলাদেশের বর্তমান নির্দলীয়-নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চড়াও হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
বর্তমান ভারত সরকারের হাসিনা সহায়ক প্রীতি কিংবা সহানুভূতি বাংলাদেশকে এক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার যে তাৎক্ষণিকভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াবে, তার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থায় কিংবা পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় নেই।
তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের অন্যান্য ছোট-বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যে সৃষ্টি করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের বড় দল বিএনপি মনে করে, এ মুহূর্তে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তারা যদি ক্ষমতায় যেতে পারে, তাহলে তারা হয়তো রাজনীতিগতভাবে দেশকে একটি শান্তি, শৃঙ্খলা কিংবা স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রয়োজন হলে তারা তাদের নেতৃত্বে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতেও প্রস্তুত। কিন্তু অন্য কিছু দল তার সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন নেতৃত্ব, নাগরিক অধিকার কমিটি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক অংশ কিংবা বিভাজনের এ ব্যাপারে ভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল রয়েছে। সে কারণে তাদের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন করাই বাঞ্ছনীয় কিংবা যুক্তিসংগত বলে মনে হতে পারে। এ ব্যাপারে সবাইকে চিন্তা-ভাবনা কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি অবকাশ দেওয়া অন্যায্য হবে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিরোধী দলের বিগত দেড় দশকের লাগাতার সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং অন্যদিকে গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে যে অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছে, তার সব কিছুই জাতীয় রাজনীতি ও আমাদের সার্বিক মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের বিগত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসন, তাঁবেদারি, দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কারণে এ দেশে অনেকেই মনে করে, শুধু ছাত্রলীগই নয়, আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল এ দেশের জনগণের রাজনীতি থেকে। এটি না হওয়ার ফলে মানুষ ক্রমে ক্রমে ভুলে যাবে অতীত দিনের সেসব পৈশাচিক রাজনৈতিক তাণ্ডব। বিএনপি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হলেও তাদের মনে হয় অতীতের জেল, জুলুম, হত্যাকাণ্ড এবং অমানবিক দিকগুলো খুব একটা স্পর্শ করেনি মানবিক বা নৈতিক দিক থেকে। হঠাৎ করে ক্ষমতায় যাওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ আসায় তারা মনে হয় সেগুলো বেমালুম ভুলতে বসেছে। এ অভিযোগ আমার নয়, বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষের মধ্যে অনেকের।
দেশব্যাপী শিক্ষিত, বিবেকবান ও রাজনীতিসচেতন অনেকে এখনো মনে করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আরো একটি দাবির কথা। সেটি হচ্ছে দেশের সংবিধান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করা। এ দেশে একদলীয় বাকশাল গঠন, সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া কিংবা অন্যান্য গণবিরোধী কাজের যাতে আর পুনরাবৃত্তি না হয় সে জন্য সর্বস্তরের মানুষকে সজাগ হতে হবে। নতুবা গণতন্ত্র মুক্ত হবে না। সুতরাং অনেকের মতে, রাজনীতিকদের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে জনগণের বিভোর হওয়া চলবে না। তাদের বুঝে নিতে হবে গণতন্ত্রের আদর্শ, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়গুলো। সে জন্যই রাষ্ট্র মেরামত কিংবা জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো এত জরুরি। এ মুহূর্তে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা আবশ্যক, না জাতীয় নির্বাচন জরুরি, তা দেশব্যাপী জনগণকেই বুঝে নিতে হবে। নতুবা একবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে বর্তমানে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজগুলো যেভাবে এগোচ্ছে, তা অবশ্যই বাধাগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সর্বোপরি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়গুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দোদুল্যমানতার মধ্যে পড়ে যাবে। অর্থনৈতিক সহায়তা এবং ঋণের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং অন্যান্য সংস্থার নতুন পর্যালোচনা ও বিবেচনার এক দীর্ঘসূত্রতায় ঝুলে পড়তে পারে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। সেগুলো চূড়ান্তভাবে ভেবে নেওয়ার এটিই মোক্ষম সময়। এখানে মূল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও সময়ের ব্যাপারটি। কখন কোন কাজটি কিভাবে করলে সংস্কার অর্থবহ, দীর্ঘস্থায়ী ও ফলপ্রসূ হবে, তা বুঝে নেওয়া।