নদী রক্ষা আন্দোলনের গল্পে সাধারণেরাই নায়ক
সাধারণত প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই নদীর অবৈধ দখলদার। তাঁদের নানান রকম পরিচয় থাকে। হয় তাঁরা বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, বড় কর্মকর্তা কিংবা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী। অবৈধ দখলদারদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনীতিক, স্থানীয় প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খুব ভালো সম্পর্ক থাকে। এই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নদী রক্ষার লড়াই খুব কঠিন। সে কারণে প্রকাশ্যে নদী দখল হতে দেখলেও সহজে কেউ এগিয়ে আসেন না।
দীর্ঘ প্রায় দেড় দশকে নদী সুরক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে দেখেছি সাধারণ মানুষ নদী সুরক্ষায় এগিয়ে আসেন। প্রভাব আছে কিন্তু নদীর দখলদার নয়, এমন ব্যক্তিরাও নদী উদ্ধারে এগিয়ে আসেন না। এর প্রধান কারণ বিত্তশালী কিংবা প্রভাবশালীদের পারস্পরিক একটি সুসম্পর্ক থাকে। তাঁরা সমাজে নিজেদের যাপিত জীবন বিঘ্ন করতে চান না। নদী রক্ষার আন্দোলন মানে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লড়াই।
আমরা যেসব জায়গায় নদী উদ্ধারে আন্দোলন সংগঠিত করেছি, তার প্রায় সবখানে পেয়েছি সাধারণ মানুষদের। এই সাধারণেরা দিনমজুর, মাঝি, জেলে, নিম্নবিত্ত কৃষক, স্কুলশিক্ষক কিংবা অন্য যেকোনো সাধারণ পেশার সাধারণ মানুষ। এমনকি ভিক্ষুকও যোগ দিয়েছিলেন নদীর আন্দোলনে। তাঁরা প্রধানত নদীকে ভালোবেসে নদী উদ্ধারে কাজ করেন।
কয়েকটি আন্দোলনের কথা বললেই বোঝা যাবে নদী কারা উদ্ধার করছেন। নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলায় দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নামের একটি ছোট নদ আছে। এই নদ আশির দশকে একদল দুর্বৃত্ত দখল করার চেষ্টা করেছিল। নদপারের সাধারণ জনগণ তা প্রতিহত করেছিল। কয়েক বছর আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজন নদটি দখল করেছিল। সাধারণ মানুষ নামতে পারত না। ডোমারের সহকারী ভূমি কমিশনার নদীর শ্রেণি পরিবর্তনের ব্যবস্থাও করেছিলেন।
স্থানীয় লোকজন এই দখল ঠেকানোর জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁরা ক্ষমতাসীন রাজনীতিক, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি অনেকের কাছে গিয়ে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তখন রিভারাইন পিপলের পক্ষে একটি কমিটি গঠন করি। এই কমিটির সভাপতি হন মাধ্যমিক স্কুলের একজন শিক্ষক আবদুল ওয়াদুদ। সদস্যসচিব হন একজন সাধারণ কৃষক মনি। আমি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করি। কমিটির অন্য সদস্যরাও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। এই খেটে খাওয়া মানুষের আন্দোলনের মাধ্যমে ওই নদ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। এখন এই নদে কোনো দখলদার নেই।
রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার শালমারা নদীর অনেকটা অংশ অবৈধভাবে দখল করেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। এই ঘটনা আশির দশকে। ওই সময়ে কয়েকজন সাধারণ মানুষ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত পাঁচজন আন্দোলনকারীকে জেলে যেতে হয়েছিল। তখন আর আন্দোলন এগোয়নি। এসব খবর জেনে আমি শালমারা নদীর পারে গিয়ে আবার আন্দোলন সংগঠিত করি।
কারাগারে যাওয়া শাহ আলম নামের একজন আন্দোলনকারীকে আহ্বায়ক এবং আরেক সাধারণ ব্যক্তি রাঙাকে সদস্যসচিব করে নদীপারের কয়েকজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে দিয়ে রিভারাইন পিপলের শাখা কমিটি গঠন করি। আমি সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এই আন্দোলনে ভিক্ষুক, জেলে, রিকশাচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সাধারণ মানুষ লড়াই করেছে। বছর তিনেক আন্দোলন করে আমরা শালমারা নদী থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে সক্ষম হই।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলায় চাকিরপশার নদী রক্ষার কাজেও প্রধান শক্তি সাধারণ মানুষ। খন্দকার আরিফ একজন সাধারণ নাগরিক। তাকে আহ্বায়ক করে আমরা একটি কমিটি গঠন করি। এখানেও আমি সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। অনেক খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। আন্দোলনের মুখে এই নদীর ১৪১ একর জমি কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন উন্মুক্ত ঘোষণা করেছে।
প্রায় ১৫ একর জমির অবৈধভাবে গ্রহণ লিখে নিয়েছিলেন ওই উপজেলার তিন প্রভাবশালী। ওই জমির ব্যক্তিমালিকানা বাতিল করেছে সরকার। ওই নদীতে জেলা প্রশাসক ১২৯টি মামলা করেছেন। লড়াই সেখানে জারি আছে। রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার খটখটিয়া নদীর অবৈধ মালিকানা বাতিলের জন্য আমাদের সঙ্গে এগিয়ে এসেছে সাধারণ জনগণ।
উল্লিখিত চারটি নদী রক্ষার লড়াইয়ে অবৈধ দখলদারেরা অনেকগুলো মামলা করেছে, বিভিন্ন সময়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে আন্দোলনকারীদের। কিন্তু সাধারণ মানুষ নদীর আন্দোলন থেকে পিছপা হয়নি। অনেক রকম হুমকি-ধমকির পরও আন্দোলনকারীরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। কেবল এই চার নদী নয়, আমাদের আরও যত নদী রক্ষার আন্দোলন রয়েছে, তার প্রধান শক্তি সাধারণ মানুষ। প্রভাবশালীদের সঙ্গে নদী উদ্ধারের আলাপ নিয়ে গেলে তারা নানা অসুবিধা দেখিয়ে কেটে পড়ে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নদী রক্ষা
- নদী বাঁচাও আন্দোলন