সাত কলেজের সমস্যা যতটা প্রশাসনিক ততটাই মনোগত তুল্যবিচারের
বছরের পর বছর সরকার, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভুক্তভোগী সাত কলেজ বিভিন্ন সমস্যার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। অধ্যাপক ড. মানস চৌধুরী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজ নিয়ে সৃষ্ট সংকট ও এর সমাধান নিয়ে।
কিছুদিন পরপর সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাজধানীর সড়ক অবরোধ করছেন। এ নিয়ে নগরবাসীর ভোগান্তি হচ্ছে। আপনার মন্তব্য কী?
অধ্যাপক ড. মানস চৌধুরী : আমি সবগুলো প্রশ্ন একত্রে পড়ে নিলাম। গোড়াতেই প্রিমাইজ বা পূর্ব-আন্দাজগুলোর বিষয়ে সতর্কতা রাখতে চাই। এই প্রশ্নগুলোর কোথাও রাষ্ট্রপলিসির আগাপাছতলা সমস্যাকে ইঙ্গিত বা টার্গেট করা হয়নি। কিংবা দেখা হয়নি যে কীভাবে খোদ প্রশাসকদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, কারসাজি, লোভ, প্রশাসনিক দুরাচার এসব সংকটকে ঘনীভূত করেছে। প্রশ্নগুলোতে মনে হয় যেন বা সাত ‘কলেজ’-এর শিক্ষার্থী আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্র্তৃপক্ষই এখানে মুখ্য পাত্রপাত্রী। আমি তা মনে করি না। আমি বিগত সরকারকে, বর্তমান সরকারকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলাদের সবাইকে এই সমস্যার কারক মনে করি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটা ফাংশনাল বডি হিসেবে সিরিয়াসলি নেওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়েছে। সেটাই এসব সমস্যার একটা মুখ্য কারণ। পক্ষান্তরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুবিধা (আমি এমনকি ‘উসকানি’ বা ‘মদদ’ শব্দও ব্যবহার করব) দেওয়ার সরকারি ব্যবস্থা থাকার মধ্য দিয়ে পুরাতন সনাতনী কলেজগুলো উপেক্ষিত হতে শুরু করেছে। ওদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মূল তাগিদ যে বিদ্যা নয়, এমনকি বিদ্যা বিক্রিও নয়, কালো টাকার ন্যায্যকরণ সেটা বোঝার জন্য কোনো পণ্ডিত হওয়া লাগে না। তাহলে সমস্যাগুলো চক্রাকার, পেঁচালো ও গভীর। সেসব উপলব্ধি ছাড়া এই সমস্যার দিকে আলোকপাত করা সম্ভব নয়, অন্তত আমার পক্ষে।
এক কথায় বললে, যদি দাবি আদায়ের জন্য অপরাপর রাস্তা বন্ধ দেখতে পান, তাহলে মানুষজন রাস্তাতে নামবেনই। পক্ষান্তরে, রাস্তায় নামার যে রাজনৈতিক ইতিহাস বাংলাদেশে আছে, তাতে এটাকে আচমকা দোষ দেওয়ার তো কোনো কারণ নেই। মাত্র ৩ মাস আগের বাংলাদেশের রাস্তায় নামা যদি ‘গ্রহণযোগ্য’ অনুশীলন হয়ে থাকে, এখনকার রাস্তা অবরোধ অসহনীয় বলতে পারেন কীভাবে? কোন ভোগান্তিটা কে কখন মানতে চান না, সেটা হলো গিয়ে আলাপের জায়গা। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রায় পিংপং বলের মতো যথেচ্ছাচার হয়েছে। তারা রাস্তায় নামার আগেই এগুলোর স্পষ্ট সমাধান করা সম্ভব ছিল। জনভোগান্তি নিয়ে আলাদা আলাপ করা লাগবে। রাস্তাঘাটের রিকশা-সিএনজি চালকদের মুখে কান পাতুন। তারা এমনকি উপদেষ্টাদের চলাচলের জন্য রাস্তা আটকানো নিয়েও একই ধরনের রসিকতা করেন যা বিগত প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের নিয়ে করতেন।
সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই থাকছে। ঢাবিতে তাদের জন্য আলাদা অবকাঠামো হবে। এতে সমস্যার সমাধান হবে?
অধ্যাপক ড. মানস চৌধুরী : সমাধান হবে কি না নির্ভর করছে, সিদ্ধান্তটি গ্রহণের গঠনপ্রণালী কেমন তার ওপর। যা কিছু ঘটেছে তাতে মনে হয় যে, সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়েছে রাস্তার উৎপাত থামানোর প্রাথমিক লক্ষ্যে। এবং অবশ্যই বর্তমান সরকার বিগত সরকারের মতো মারপিট করে রাস্তা খালি করার সুবিধা দেখেন না বলে। যদি সেটা হয় তাহলে কোনো গুরুতর সমাধান হতে যাচ্ছে না। আলাদা অবকাঠামোর বিষয়ে আমি জানতাম না, আপনার কাছ থেকেই জানলাম। অবকাঠামো বলতে দুচারটা বিল্ডিং নিশ্চয়ই তারা বোঝাচ্ছেন না। খুব সাধারণ কমনসেন্সেও বলা যায়, যদি মেডিকেল কলেজগুলোর মতো এত জটিল প্রতিষ্ঠানও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামলাতে পারে, তাহলে সাতটা কলেজ সামলাতে না-পারার কোনোই কারণ নেই। কলিগদের বিচ্ছিন্নভাবে মাঝেমধ্যে যতই দুবলা মনে হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক লিগ্যাসি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সেটাকে আরও পোক্ত, ক্ষিপ্র বানানোও সম্ভব। কিন্তু সমস্যাটার একটা সমাজ-মনোগত দিক আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও পপুলেশন কলেজগুলোকে যথেষ্ট ‘মর্যাদাসম্পন্ন’ ভাবেন কি? উপেক্ষা, অবজ্ঞা, তির্যকতা, অশ্রদ্ধা কত ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে তার নমুনা আমাদের আমৃত্যু মনে থাকার কথা। আমার গভীর প্রত্যয় জন্মেছে যে, সাত কলেজের সমস্যা যতটা প্রশাসনিক ততটাই মনোগত তুল্যবিচারের। যদি কলেজগুলোর ‘মর্যাদা’ বিষয়ে সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট সতর্ক না হয়, সমস্যাটার একটা ফাটল নতুন অবকাঠামোতেও থেকে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ নিয়ে হিমশিম খায়। এর মধ্যে সাত কলেজের দিকে মনোযোগ দেওয়া কি সম্ভব?
অধ্যাপক ড. মানস চৌধুরী : আপনার আগের বার্তার সঙ্গেই এটা সাংঘর্ষিক। যদি নতুন ‘অবকাঠামো’ খোলাই হয়ে থাকে তাহলে হিমশিম খাওয়ার তো কারণ থাকবে না। আবারও বলি, সব রাষ্ট্রেই সব ধরনের মাপের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। নানান ধরনের সে সবের ‘অবকাঠামো’। বাংলাদেশে ইংরেজি স্কুলগুলোর দিকে তাকান। সারা বিশ্বের দিকে তাকান। কমবেশি ১০০টা রাষ্ট্রে ও-লেভেল এ-লেভেল কার্যক্রম চালু আছে। খোঁজ নিলে জানবেন অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ মিলে ব্রিটেনেও কমবেশি ৭/৮টা বিদ্যা-প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান এতে জড়িত। আদার ব্যাপারী বলে এর থেকে বড় জাহাজের খোঁজ নিইনি। কিন্তু আরও জরুরি হলে বিশদেই খোঁজ নেওয়া যাবে। বিষয় হলো, চলছে তো ব্যবস্থাটা। গ্রাহকরাও খুবই খুশি বলেই মনে হয়। এদের লোকাল-কাউন্টারপার্টে তো বিভিন্ন লোকজনও কাজ করছে। তাহলে এগুলোর নজির তো আছে যে সামলানো সম্ভব। সরকারের নিয়ত ও পরিকল্পনা কী, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ত ও পরিকল্পনা কী, সেই পরিকল্পনার সঙ্গে মানানসই ব্যবস্থাপনা টিম বানানো হয়েছে কি না, এগুলো হচ্ছে বিষয়। শর্তগুলোর পর্যালোচনা ছাড়া সামর্থ্যরে বিষয়ে মন্তব্য করার জায়গা নেই।