বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
প্রথাগতভাবে দারিদ্র্যের আলোচনায় আয়-দারিদ্র্যই প্রাধান্য পায়; বিশ্লেষণাত্মক বিতর্ক ও পরিমাপেও। কিন্তু এ কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত, দারিদ্র্য বিষয়টি একরৈখিক কিংবা একমাত্রিক নয়। আয়বহির্ভূত বিষয়গুলোতেও বঞ্চনা থাকতে পারে। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সুপেয় পানি কিংবা কর্মনিয়োজনে। আয়ের ঘাটতি সবসময় এসব বঞ্চনা প্রতিফলিত করতে পারে না। যেমন একজন ব্যক্তি অত্যন্ত ধনশালী হতে পারেন। তিনি অশিক্ষিত হলেও আয়-দারিদ্র্যে দরিদ্র নন; কিন্তু শিক্ষা মাত্রিকতায় তিনি বঞ্চনার শিকার। কিন্তু কোন মাত্রিকতায় বঞ্চনা সবচেয়ে তীব্র বা চরম, তা বস্তুনিষ্ঠ, অনপেক্ষভাবে নির্ধারণ করা যায় না– বিষয়টি আপেক্ষিক এবং সেই সঙ্গে মানসিকও বটে। একেক মানুষের কাছে একেক ধরনের বঞ্চনা অগ্রাধিকার পাবে।
এটিও মনে রাখা দরকার, মানব উন্নয়ন শুধু মানুষের বস্তুগত কুশলের ওপরে নির্ভর করে না; তাঁর কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, তাঁর অংশগ্রহণের অধিকার, মানুষ-পরিবেশ ভারসাম্য ইত্যাদির ওপরেও নির্ভর করে। বস্তুগত কুশল অর্জন করার পরও মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাও থাকতে পারে। অথবা ব্যক্তিগত কুশল অর্জনকারী মানুষকে যদি গাত্রবর্ণের কারণে বিভিন্ন সামাজিক স্থান বা অনুষ্ঠানে প্রবেশাধিকার দেওয়া না হয়, তাহলে সে ঘাটতিও তার বঞ্চনা। সুতরাং, চূড়ান্ত বিচারে মানব-দারিদ্র্য একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক।
বহুমাত্রিক এ দারিদ্র্য পরিমাপে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি এবং অক্সফোর্ড দারিদ্র্য ও মানব উন্নয়নের যৌথ প্রচেষ্টায় বেশ ক’বছর আগে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক গঠিত হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবনযাত্রার মানের ১১টি সূচক (পুষ্টি, বিদ্যালয়ে উপস্থিতি, সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি) নিয়ে সমন্বিত সূচক গড়ে উঠেছে।
সূচকটি সম্পর্কে তিনটি পর্যবেক্ষণ প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, সূচকটি দারিদ্র্য পরিমাপের একরৈখিক মানদণ্ড নয়। যেহেতু বঞ্চনার অন্যান্য দিকও ধর্তব্যের মধ্যে আনে, তাই এটি বহুমাত্রিক। দ্বিতীয়ত, যদিও বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক আয়-দারিদ্র্যের তুলনায় একটি ব্যাপ্ত পরিমাপ। যেহেতু এই সূচকে আয় অন্তর্ভুক্ত নয়, সুতরাং এটি মূলত আয়বহির্ভূত দারিদ্র্যের ওপরেই নজর দেয়। ফলে আয়-দারিদ্র্যের আপাতন বুঝতে হলে আলাদা করে আয়-দারিদ্র্যের পরিমাপের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তৃতীয়ত, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক শুধু মানুষের বস্তুগত কুশলকেই আমলে আনে। কিন্তু মানুষের কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, তার অংশগ্রহণের অধিকার, মানুষ-পরিবেশ ভারসাম্যের ব্যাপার সে সূচকের অর্ভুক্ত নয়। সুতরাং এটি বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের তাৎপর্যপূর্ণ সীমাবদ্ধতা।
গত সপ্তাহে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের ওপরে সাম্প্রতিকতম বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের উপাত্ত নিয়ে বিশ্বের ১১২টি দেশের জন্য সূচকটি নির্মিত। বাংলাদেশও সেই সমীক্ষায় আছে; উপাত্তের সমীক্ষাকাল ২০১৯। সেই সমীক্ষাবর্ষের উপাত্তকে সম্মুখ প্রাক্কলনের মাধ্যমে ২০২২ সালের উপাত্ত গড়ে তোলা হয়েছে।
প্রতিবেদন ফলাফলে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৬৩০ কোটির মধ্যে ১১০ কোটি মানুষ (১৭ শতাংশ) বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। এই বহুমাত্রিক দরিদ্র মানুষের ৯৬ কোটি (৮৪ শতাংশ) আবার গ্রামে বাস করে। অন্যদিকে বহুমাত্রিক দরিদ্রদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যকই শিশু-কিশোর। অর্থাৎ প্রায় ৫৪ কোটি শিশু-কিশোর বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। সুতরাং বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের তাৎপর্যপূর্ণ গ্রামীণ ও তারুণ্য মাত্রিকতা আছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট ফলাফলের দিকে তাকালে দেখি, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ এদেশে প্রতি ৪ জনে ১ জন বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। সামগ্রিক সংখ্যার দিক থেকে ২০২২ সালে দেশের ৪ কোটি ১৭ লাখ লোক বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে বসবাস করেছিল। এ দেশের ৭ শতাংশ লোক চরম বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে আক্রান্ত। ১৮ শতাংশ লোক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য-নাজুক; যারা এখনও বহুমাত্রিক দরিদ্র নয়, কিন্তু সংকট ঘটলে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য-ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা আছে।
বাংলাদেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের ৪৫ শতাংশই জীবনযাত্রার মানের বঞ্চনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। শিক্ষা-বঞ্চনা সামগ্রিক বঞ্চনার ৩৮ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য বঞ্চনা ১৭ শতাংশে অবদান রাখে। সুতরাং বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হ্রাসে শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মানে জোর দিতে হবে।
বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে যদি এ দেশের আয়-দারিদ্র্যের সঙ্গে তুলনা করি, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন যেখানে ২৫ শতাংশ, সেখানে আয়-দারিদ্র্যের আপাতন ১৯ শতাংশ (জাতীয় দারিদ্র্য রেখা অনুসারে)। অর্থাৎ বাংলাদেশে যত লোক আয়-দরিদ্র, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বহুমাত্রিক দরিদ্র। সুতরাং আয়ের ঘাটতি দিয়ে এ দেশের মানুষের সব বঞ্চনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। বিশ্বব্যাংকের চরম আয়-দারিদ্র্যের নির্ণায়কে (ক্রয়ক্ষমতার সমতাভিত্তিক দিনপ্রতি ২.১৫ ডলার পরিমাপে) বাংলাদেশের ৫ শতাংশ লোক চরম আয়-দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। যেহেতু এ দেশের ৭ শতাংশ লোক চরম বহুমাত্রিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, এটি পরিষ্কার– চরমভাবে দরিদ্র মানুষের মধ্যে আয়ের বঞ্চনার চেয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার বঞ্চনাই বেশি তীব্র।