সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী রাজনীতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগ ও সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ।
আপনারা দীর্ঘদিন ধরে সুষ্ঠু নির্বাচন ও সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। ২০২৪ সালে এসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতন হলো। এই গণ-অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক তাৎপর্য কী?
বজলুর রশীদ ফিরোজ: যেকোনো সাফল্যের পেছনে মানুষের শ্রম থাকে, সংগ্রাম থাকে, তেমনি রাজনৈতিক আন্দোলনের সাফল্যের পেছনেও থাকে দীর্ঘদিনের লড়াই। দুর্নীতি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন তো ছিলই, এর সঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করা নিয়ে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪—এই তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল।
এর বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে এসে ছাত্র–জনতা–শ্রমিকের সফল অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন হয়েছে। শুধু ৩৬ দিনের আন্দোলনেই গণ–অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে—এভাবে ভাবাটা ঠিক নয়।
এই অভ্যুত্থানে দুটি বিষয় গণ–আকাঙ্ক্ষারূপে হাজির হয়েছে। একটি হলো বৈষম্যবিরোধিতা; অপরটি ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি অপসারণ। এই অভ্যুত্থানের শ্রেণিগত সক্ষমতার প্রশ্ন রয়েছে। তবে এর রাজনৈতিক তাৎপর্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী।
গণ–অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস পেরিয়ে গেছে। এই সরকারের কর্মকাণ্ডকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বজলুর রশীদ ফিরোজ: সামগ্রিক পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতা ও অরাজকতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যতটা মনোযোগ প্রয়োজন ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সেটা দিতে পেরেছে বলে মনে হয় না। দুই মাস যদিও যথেষ্ট সময় নয়, তবু দ্রব্যমূল্য, বাজার পরিস্থিতি ও শ্রমজীবী দরিদ্র জনজীবনের দুর্দশা লাঘবে ব্যর্থতা স্পষ্ট। সরকারের কাজের সমন্বয়হীনতা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের অগ্রাধিকার নির্ধারণে অস্পষ্টতা রয়েছে।
বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি শব্দ হলো সংস্কার। অন্তর্বর্তী সরকারও সংস্কারের কথা বলছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এসব কমিশনের কাছে আপনাদের প্রত্যাশাগুলো কী?
বজলুর রশীদ ফিরোজ: এই কমিশনগুলো সমস্যা পুরোপুরি সমাধান করবে না; তবে সমাধানের কিছু পথ দেখাবে—জনগণ এমন প্রত্যাশা করে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংকট চিহ্নিত করা, সমাধানের পথ নির্দেশ করা এবং খানিকটা দূর করার উদ্যোগ নেবে কমিশনগুলো।
তবে মীমাংসিত বিষয়ে নতুন বিতর্কও যেন সংকটের জন্ম না দেয়, সে ব্যাপারে কমিশনকে সতর্ক থাকতে হবে। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সংস্কারের রূপরেখা, পরিধি, সময়সীমা ইত্যাদি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা না হওয়ায় পুরো বিষয়টি এখনো অন্ধকারে রয়েছে।
সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী? বাহাত্তরের সংবিধানের সংশোধন না নতুন সংবিধান প্রণয়ন—আপনাদের দাবি কোনটা?
বজলুর রশীদ ফিরোজ: ৫২ বছর ধরে যারা দেশ শাসন করেছে, ক্ষমতার স্বার্থে তারা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানকে অস্বীকার করেছে কিংবা পাশ কাটিয়েছে অথবা বিকৃত করে গোঁজামিলের দলিলে পরিণত করেছে। আপাতত অগণতান্ত্রিক সংশোধনীগুলো বাতিল করে বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বীকৃতি, সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীর সমানাধিকার, মৌলিক অধিকারের আইনি সুরক্ষা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা এবং ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে সংশোধন করলেই চলবে বলে মনে হয়। একটি সুষ্ঠু–অবাধ নির্বাচনসহ প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার ন্যূনতম সংস্কার করার চেয়ে এই সরকারের বেশি কিছু করা উচিত হবে না।