মুক্তির যুদ্ধ চলছে, বিজয় অবশ্যম্ভাবী
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা কেউই সাধারণ অপরাধী ছিল না, চোর বা পকেটমার নয়, তারা গণহত্যাকারী। এবং আমরা যে এত দিনেও তাদের রাজনীতি থেকে বিচ্যুত করতে পারিনি সে ব্যর্থতা আমাদেরই বরং অপরাধী করে রেখেছে। আমরা আজ অপরাধী আমাদের শহীদদের কাছে, অতীত ও বর্তমান প্রজন্মের কাছে, নিজেদের বিবেকের কাছে এবং সমগ্র বিশ্বের কাছে। বিশ্বের সব বিবেকমান মানুষই চায় স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার অধিকার রহিত হোক।
সেটা সম্ভব না হওয়ার ব্যর্থতা আমাদের জন্য অপরাধ তো বটেই, মস্ত বড় লজ্জাও।
ন্যায়বিচার, নানা অপরাধের শাস্তি, দুর্নীতি দমন—এসব আওয়াজ হরহামেশাই শোনা যায়। কিন্তু সব অপরাধই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের তুলনায় সামান্য। কেননা যুদ্ধাপরাধীরা যা করেছিল তা হলো জাতিগত গণহত্যা।
ওই গণহত্যাকারীদের রাজনীতি থেকে বিদায় আমরা করতে পারিনি, তখন অন্যান্য দুষ্কর্মের বিস্তার রোধ হবে এমনটা আশা করি কী করে? আমাদের বিচারব্যবস্থায় এক শ একটা গলদ খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু তার গোড়ার গলদটা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যেসব অপরাধীর অপরাধকে পরাভূত করে ঘটেছে, তাদের স্থায়ী রোধে জাতির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারা। অত বড় অপরাধ করে যদি পার পাওয়া যায়, তবে ছিঁচকে অপরাধীরা ভয় পাবে কেন? ভয় পাচ্ছেও না।
এই যে আমরা সব দুর্নীতি, দুষ্কর্মের বিচার দাবি করছি, এটা প্রতিহিংসার ব্যাপার নয়, ব্যাপার ন্যায়বিচারের। বিচার করতে না পারলে নৈতিকভাবে আমরা পরাজিত হয়ে যাব, অতীতের ধারাবাহিকতায়।
আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে ভালোবাসি, কিন্তু ঘৃণাহীন ভালোবাসা তো কোনো ভালোবাসা নয়, তাতে না থাকে গভীরতা, না থাকে আন্তরিকতা। দেশকে ভালোবাসতে হলে দেশের শত্রুদের ঘৃণা করতে হয়। প্রবল ভালোবাসার প্রয়োজনেই প্রচণ্ড ঘৃণা চাই। আর শত্রুকেই যদি না চিনি, তবে মিত্রকে চিনব কী করে? শত্রুদের আমরা মিত্রদের থেকে আলাদা করতে পারিনি এবং মিত্র খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছি শত্রুকে তার তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরও আমরা ধিক্কার দিতে চাই, প্রমাণ করতে চাই যে মানুষের জীবন মূল্যবান এবং মনুষ্যত্বের অবমাননা ঘটিয়ে পার পাওয়া যায় না।
কেউ পায়নি কখনো, ছদ্মবেশী আত্মগোপনকারী যুদ্ধাপরাধীরাও পাবে না, যারা এখন ক্রমাগত আত্মপ্রকাশ করে চলেছে।
এই যুদ্ধাপরাধীরা দেশের বাইরে থেকে এসেছিল; ছিল তারা দেশের ভেতরেও। বাইরে ছিল বর্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী; ভেতরে ছিল তাদের দোসর বেঈমান রাজাকার, আলবদর, আলশামস। দুই পক্ষ মিলে এক পক্ষ হয়েছিল এবং যে নৃশংসতা ও নির্লজ্জতা সেদিন তারা প্রদর্শন করেছিল, তার তুলনা আছে কি না সন্দেহ। আমাদের মা-বোন-ভাই-বাবা-আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধবকে তারা যেভাবে হত্যা করেছে, লাঞ্ছিত করেছে, মৃত ও লাঞ্ছিতদের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করেছে, সেটা ছিল দানবীয়। আমরা যারা কোনোক্রমে বেঁচে গেছি এবং যারা আমাদের পরে এসেছে ও সৌভাগ্যক্রমে ওই দানবদের মুখোমুখি হয়নি, তাদের কি অধিকার আছে ওদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেওয়ার?
- ট্যাগ:
- মতামত
- মুক্তিযুদ্ধ
- ন্যায়বিচার