বিচার বিভাগ নিয়ে বেশি অনাস্থা তৈরি হয় আওয়ামী আমলে
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের আগে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়েও অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত, কোথাও ন্যায়বিচার পাওয়া যায়নি—প্রায়ই এ রকম অভিযোগ উঠেছে। গত সরকারের আমলে বিচার বিভাগ নিয়ে এমন প্রশ্ন ও অভিযোগগুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
এম এ মতিন: আদালতে যত মামলা হয়ে থাকে, তার একটা বড় অংশই সরকার বনাম নাগরিকের মামলা। অনেক সময় এসব মামলায় সরকার ও সরকারদলীয় লোকজনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল। এসব কারণেই বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল। গত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদেই এটা শুরু হয়। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে এটা সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
এই দুই মেয়াদে বিচার বিভাগে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ করা হয়। উচ্চ আদালতে এমন কিছু লোককে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যাঁদের আইনকানুন, বিচার সম্পর্কে পর্যাপ্ত জানাশোনা নেই এবং এমনকি তাঁদের মেরুদণ্ডও নেই। তাঁরা যে নিজেদের যোগ্যতায় নয়, সরকারের কৃপায় বিচারক হয়েছেন, এটা তাঁরা জানতেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের কোনো নৈতিক শক্তি ছিল না। তাঁরা যেমন সরকারের নির্দেশনামতো কাজ করতেন, অনেক সময় আবার সরকার কিছু না বললেও সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ভবিষ্যতে সরকারের কাছ থেকে আরও সুবিধা পাওয়ার আশা থেকেই তাঁদের মধ্যে এমন প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এ কারণে তাঁদের পক্ষে ন্যায়বিচার করা সম্ভব ছিল না।
এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে বিচার বিভাগ নিয়ে একধরনের আস্থার অভাব তৈরি হয়েছিল। সহজভাবে বলা যায়, দলীয়করণ, অযোগ্য ও মেরুদণ্ডহীন লোকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগের ফলে বিচার বিভাগ নিয়ে অনাস্থা তৈরি হয়েছিল। বিচার বিভাগ নিয়ে অনাস্থা হয়তো আগেও কিছুটা ছিল, তবে গত সরকারের আমলে যেটা হয়েছে, তা সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
মাসদার হোসেন মামলার সূত্র ধরে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ২০০৮ সালের আগের তুলনায় এরপর বিচার বিভাগের ভূমিকা বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাহলে বিচার বিভাগ পৃথক করে কি কোনো লাভ হলো?
এম এ মতিন: মাসদার হোসেন মামলার রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। কিন্তু সেখানে যে ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি। কিছু বিষয় ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ (সুবিধামতো বাছাই) করা হয়েছে। কোনো একটা স্কিম বা প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হলে সেটা ভালোর চেয়ে খারাপ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করতে চাইলে এই পৃথক্করণের পথে যত সাংবিধানিক, আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক, এমনকি অর্থনৈতিক বাধা আছে, তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল। তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এর ফলে সত্যি সত্যি বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে বা নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়েছে—এমনটা বলা যায় না।
নতুন বিচারপতি সৈয়দ রিফাত আহমেদ সম্প্রতি বিচার বিভাগ নিয়ে একটি ‘রোডম্যাপ’ দিয়েছেন। সেটাকে কীভাবে দেখছেন?
এম এ মতিন: তিনি যা বলেছেন, সেটা বেশ ইতিবাচক। এগুলোর অনেক কিছুই মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনায় বলা হয়েছিল। সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, আলাদা বাজেট বরাদ্দ দেওয়া এবং নিম্ন আদালতগুলোকে সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে নিয়ে আসা—এ বিষয়গুলো নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ একটি বাধা। এই অনুচ্ছেদের ফলে বিচার বিভাগে এখন ‘দ্বৈত শাসন’ চলছে। নিম্ন আদালতকে পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনতে হলে এটাকে বাহাত্তরের সংবিধানে যেভাবে ছিল, সেই অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিচার বিভাগ
- বিচার ব্যবস্থা
- আওয়ামী লীগ