হাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প
‘আমি তাকে এমন একটি প্রস্তাব দেব, যা সে ফিরিয়ে দিতে পারবে না’। ‘দ্য গডফাদার’ সিনেমার এই বিখ্যাত সংলাপ আসলে একটি হুমকি। যখন মাফিয়াপ্রধান কিছু বলেন, তা মানা ছাড়া উপায় নেই।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন—উন্নয়ন, নাকি গণতান্ত্রিক অধিকার? এ–ও ছিল এমন এক প্রস্তাব, যা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না।
কিন্তু গণতন্ত্রকে শ্বাসরোধ করে ও মানবাধিকারকে পিষে উন্নয়নকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব? শেখ হাসিনার তথাকথিত উন্নয়নের দাবিগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকা বাস্তবতাগুলোকে তথ্যনির্ভর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উন্মোচন করা প্রয়োজন।
মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি)
জিডিপি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও অপব্যবহৃত উন্নয়নের সূচক। আর তা ছিল হাসিনা শাসনের সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয়। হাসিনার মন্ত্রীরা প্রায়ই আমাদের বলতেন যে তাঁরা বাংলাদেশের জিডিপি ২০০৯ সালে মাত্র ১০২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছেন। শুনতে সত্যিই এক বিরাট কৃতিত্বের মতো শোনায়! কিন্তু এটিও আরেকটি মিথ্যাচার। এখানে কয়েকটি ফাঁক আছে।
প্রথমত, এই তথ্যের সত্যতা নিয়ে কতটা নিশ্চিত হওয়া যায়? হাসিনার পতনের কয়েক সপ্তাহ আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর রপ্তানি পরিসংখ্যান সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ব্যুরো প্রায় ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত দেখিয়েছিল। যদিও তারা ব্যাখ্যা করে যে এর ফলে জিডিপিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। তা যদি না–ও হয়, তবু এটি জিডিপির অন্য উপাদানগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে।
দ্বিতীয়ত, জিডিপি শুধু তখনই উন্নয়নের সূচক, যখন বেশির ভাগ অর্থনৈতিক কার্যক্রম উৎপাদনশীল হয়। যখন সন্দেহজনক মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয় অযৌক্তিকভাবে বেশি হয়, তখন জিডিপি আকাশচুম্বী হবে। কিন্তু তাতে জনগণের প্রকৃত কোনো উপকার হবে না। তাদের জীবনমান উন্নত হবে না, ভোগান্তি কমবে না। বরং জিডিপি নিয়ে আস্ফালন করাটা যে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসের আরেকটি প্রয়াস, তা আজ জনগণ জানে।
এগুলো ছাড়াও কিছু পদ্ধতিগত কূটকৌশলও আছে। মূলত জিডিপি যৌগিক সুদের মতো কাজ করে। যদি কোনো দেশের জিডিপি ১০০ টাকা হয় এবং তা ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়, তাহলে তা ১০৫ টাকা হবে। পরের বছরে একই হারে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে তা ১১০ টাকা হবে না, ১১০ দশমিক ২৫ টাকা হবে। তাই ১৫ বছর আগের জিডিপির সঙ্গে তুলনা করে আপনি বড় সাফল্য দাবি করতে পারেন না। সরকারগুলোর পারফরম্যান্স তুলনা করতে হলে বছর ধরে প্রবৃদ্ধির হার হিসাব করতে হবে।
আবার যখন জনসংখ্যা বাড়ে, তখন জিডিপিও বাড়ে। কারণ, জিডিপির সবচেয়ে বড় উপাদান হলো ব্যক্তিগত ভোগ। সহজ কথায়, যদি খাওয়ার জন্য বেশি মুখ থাকে, তবে পারিবারিক ব্যয়ও বেশি হবে এবং সেই ব্যয় জিডিপিতে যোগ হবে। তাই সময়ের সঙ্গে তুলনা করার জন্য মাথাপিছু জিডিপি ব্যবহার করতে হবে।
১৫ বছর আগের ১০০ টাকার একই মূল্য এখন আর নেই। তাই তুলনার জন্য বর্তমান দামে নয়, নির্দিষ্ট মূল্যের ভিত্তিতে জিডিপি মাপা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ গত ১৫ বছরে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে (সম্ভাব্য তথ্য হেরফের সত্ত্বেও)। কিন্তু কোথায় সেই ব্যতিক্রমী উন্নয়ন? প্রকৃতপক্ষে বিএনপি দুবার স্থবির অর্থনীতিকে চাঙা করেছে এবং নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি বিএনপির সর্বশেষ মেয়াদের শেষের দিকে হয়েছিল। বিএনপি নিজেও হয়তো এ বিষয়ে সচেতন নয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দেশের উন্নয়ন
- জিডিপি প্রবৃদ্ধি