‘মব জাস্টিস’ বনাম ‘আইনের শাসন’
গণপিটুনি এ দেশে অনেকটা ডাল-ভাতের মতো একটা ব্যাপার। চলতি পথে ‘ধর ধর, মার মার’ চিৎকার কানে এলেই হলো, অমনি উত্তেজিত জনতা পঙ্গপালের মতো হুমড়ি খেয়ে চড়াও হয় নিরস্ত্র লোকটির ওপর। সঙ্গে শুরু হয় চড়-কিল-ঘুসির মাধ্যমে দোষী বা নির্দোষ লোকটির বিচার বা ‘জাস্টিস’। শুরু হয় আয়েশ আর খায়েশভরা উত্তম-মধ্যম। আগে ছেলেধরা, চোর-ডাকাত বা ছিনতাইকারী সন্দেহেই মূলত ঘটত গণপিটুনির ঘটনা। হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন এর শিকার হচ্ছে মূলত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সাবেক মন্ত্রী-সংসদ সদস্য বা তাদের অনুরাগীরা। এখন হাটে-বাজারে, মাঠে-ময়দানে কোথাও ‘লীগ’ (যে ‘লীগ’ই হোক না কেন!) পেলেই হলো; অমনি রামধোলাই। এমনকি সীমান্তে, আদালত চত্বরে পুলিশ পরিবেষ্টিত থাকাবস্থায়ও অনেকে এমন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। কোথাও ‘ছাত্রলীগ’ দেখলেই হলো, ছাত্র-জনতা সঙ্গে সঙ্গে খুনে মেজাজে হয়ে যাচ্ছে। এই তো গত ৭ সেপ্টেম্বর আবদুল্লাহ আল মাসুদ নামের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে ছাত্র-জনতা পিটিয়ে হত্যা করে।
১৮ সেপ্টেম্বর বিকালে ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে ক্যাম্পাসেই ছাত্ররা দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করে। একই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে চোর আখ্যা দিয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে তিন দফায় পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনি, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর পোড়ানো, আদালত চত্বরে তাদের চড়-থাপ্পড়, ডিম-জুতা নিক্ষেপসহ বহুমাত্রিক ‘মব জাস্টিসের’ (উত্তেজিত/উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার) ঘটনা ঘটে। তবে দেশের সেরা ও সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে গণপিটুনির নামে এমন হত্যাকাণ্ড বা নির্মম ‘মব জাস্টিসের’ ঘটনা বিরল। একই সঙ্গে তা ভয়াবহ বিপজ্জনক। কারণ ছাত্রদের হাতেই এখন দেশের নেতৃত্ব। দুজন ছাত্র উপদেষ্টাসহ ছাত্র-জনতার সরকারের হাতে এখন দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের হাতে দেশে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ভার। অথচ কিছু ছাত্র এখন আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, দিন-দুপুরে মানুষ ‘খুন’ করছে, এটি উদ্বেগজনক। তর্কের খাতিরে ধরলাম, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বিগত সময়ে গণপিটুনি বা এমন মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটত। কিন্তু এখন তো ছাত্রদের সরকার। সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে, কর্তৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। তাহলে কেন আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো?
প্রকৃতপক্ষে গণপিটুনি ব্যাপারটি কেবল অমানবিকই নয়, সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধও বটে। বিষয়টির ব্যাখ্যা করছি। আইনের আশ্রয় লাভ, আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ, বিচার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ অপরাধী-নিরপরাধ নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার [বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ]। অন্যদিকে অপরাধীকে গ্রেফতার করা পুলিশের আইনগত দায়িত্ব। কোনো ব্যক্তি এ কাজ করতে পারে না। তাই ব্যক্তির হাতে কোনো অপরাধী ধরা পড়লে তাকে সরাসরি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। অন্যথা গুনতে হবে অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। চোর, ডাকাত, ছেলেধরা বা অন্য কোনো অপরাধীকে আটক করে, পুলিশের কাছে হস্তান্তর না করে যদি তাকে আটকে রাখা হয়, তাহলে অন্য অর্থে তা পুলিশকে তার কর্তব্য পালনে বাধাদানের মতো অপরাধ হিসাবে গণ্য হতে পারে; যার শাস্তি অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড [১৮৬, ১৮৭ ধারা, দণ্ডবিধি; ৫৯ ধারা, ফৌজদারি কার্যবিধি]।
কাউকে আটকে রেখে গুরুতর ও আকস্মিক উত্তেজনাবশত যদি তাকে পিটুনি দেওয়া হয়, তাহলে কারাদণ্ডের আগের মেয়াদ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব তিন বছর এক মাসে। সঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড তো আছেই। সেই পিটুনি দিতে গিয়ে যদি আঘাতটা গুরুতর হয়ে যায়, তাহলে আগের কারাদণ্ডের মেয়াদের সঙ্গে যোগ হবে আরও এক বছর। তখন অর্থদণ্ড হবে অনূর্ধ্ব ২ হাজার টাকা। অবশ্য এক্ষেত্রেও কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড, উভয় দণ্ডও হতে পারে [৩৩৪, ৩৩৫ ধারা-দণ্ডবিধি]।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গণপিটুনিতে নিহত
- মব জাস্টিস