অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনে আন্তর্জাতিক আইনের সায়
অনেকের মতে, পৃথিবীতে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তবে সে যুদ্ধ হতে পারে পানি বিরোধকে কেন্দ্র করে। কথাটার সত্যতা কতটুকু, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তবে বাংলাদেশকে যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি অপেক্ষা করতে হবে না, সেটা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়। সম্প্রতি ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, এমনকি চট্টগ্রামের কিছু অংশে স্মরণাতীতকালের বন্যা সে কথাই প্রমাণ করে। এটা যেন শুকিয়ে মারা আবার ডুবিয়ে মারা। গ্রীষ্মে পানির হাহাকার, আবার বর্ষায় পানিতে সব স্বপ্নের সমাধি। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে এ ছেলেখেলা কি প্রাকৃতিক, না মানবসৃষ্ট? নিজ গাফিলতি আছে তো বটেই, তবে অন্য কেউ কি এর জন্য দায়ী?
সরকারি তথ্যমতে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যৌথ নদী ৫৭টি, কিন্তু কিছু গবেষকের মতে যৌথ নদীর সংখ্যা আরও বেশি। অনেকের মতে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে পানি নিয়ে খেলছে। ইচ্ছে হলে দিচ্ছে, ইচ্ছে না হলে দিচ্ছে না। আবার যখন পানির প্রয়োজন নেই, তখন ভাসিয়ে দিচ্ছে, প্রয়োজনে গলা ফাটালেও দিচ্ছে না। ইচ্ছে হলেই নদীর ওপর বাঁধ বানাচ্ছে, আবার ইচ্ছে হলেই পানি সরাচ্ছে। ইচ্ছে হলেই নদীর বাঁধ ছেড়ে দিচ্ছে, আবার ইচ্ছে হলেই বাঁধ বন্ধ করে দিচ্ছে। আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্পের মতো। কিন্তু পৃথিবী তো আলিবাবার গুহা নয়, যে ইচ্ছে হলেই খুলব আর ইচ্ছে হলেই বন্ধ করব। তবে বাংলাদেশের ভাগ্য যে সেভাবেই চলছে! কেন? সে লম্বা কাহিনি। অনেকের মতে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিভীষিকাময় বন্যা অনেকটা আলিবাবা চল্লিশ চোরের গুপ্ত গুহা খোলার জন্যও দায়ী। আন্তর্জাতিকভাবে পানিসম্পদ সমস্যার গ্রহণযোগ্য ও আইনানুগ নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে, ১৯৭০ সালে জাতিসংঘ আন্তঃসীমা পানিসম্পদ দ্বন্দ্ব দূরীকরণে আন্তর্জাতিক আইন কমিশনকে আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন নীতিমালা আইনবদ্ধ করতে ও উন্নয়নের জন্য অনুরোধ জানায়। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ তিন দশক কাজ করার ফলে ‘আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ সম্মেলন’ আয়োজন সম্ভব হয়। বিশ্ব-পরিবেশ সংক্রান্ত কর্মসূচির ব্যাপ্তি ঘটে সত্তরের দশকে, যা বিকশিত হয় ১৯৭২ সালে সুইডেনের ‘স্টকহোম’ সম্মেলনে। জাতিসংঘের আন্তঃসীমা পানিসম্পদ নিয়ে উদ্বেগের কারণেই ১৯৭৭ সালের মার ডেল প্লাটা সম্মেলনে ১১টি প্রস্তাব ও ১০২টি সুপারিশ গ্রহণের মাধ্যমে এক আন্তর্জাতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। পানিসম্পদ ব্যবহারের আন্তর্জাতিক নীতির এক খসড়া মেক্সিকো ও সহযোগী ৩৩টি দেশ ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭৭ সালের ২৩ মে The Convention on the Law of the Non-Navigational Uses of International Watercourses বিপুল ভোটে পাশ করে। ১০৪টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, তিনটি দেশ বিপক্ষে এবং ২৬টি দেশ ভোট প্রদানে বিরত থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ সংকট নিয়ে নেদারল্যান্ডসের ‘হেগে’ অনুষ্ঠিত হয় মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন।
আন্তর্জাতিক নদী ও হ্রদ সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ গৃহীত চুক্তি সিদ্ধান্ত ১(৪২) এবং ১(৪৪) অনুসারে ‘আন্তঃসীমার পানিসম্পদ’ হচ্ছে দুই বা ততোধিক দেশের মাটির নিচ বা ওপর দিয়ে অবস্থিত বা প্রবাহিত যে কোনো ধরনের পানিসম্পদ।
এখানে উল্লেখ্য, জাতিসংঘের পানিসম্পদ ব্যবহারের নীতিমালার ৫(১) অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, আন্তর্জাতিক পানিসম্পদে সুষম ও যুক্তিসংগত ব্যবহার যাতে অপর দেশের পানিসম্পদ ব্যবহারে কোনো ক্ষতির কারণ না হয়। আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ নীতির ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, পানিসম্পদের তীরবর্তী দেশগুলো তার নিজস্ব সীমানার অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ ব্যবহারে এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যাতে করে অপর রাষ্ট্রের পানিসম্পদে উল্লেখযোগ্য কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া না পড়ে। ৭(২) অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, কোনো চুক্তি ব্যতিরেকে পানিসম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে যদি পানিসম্পদ তীরবর্তী অপর দেশে কোনো উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তখন অনুচ্ছেদ ৫ ও ৬ অনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ক্ষতিকর সব কারণ দূর ও প্রশমিত করবে, প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ বিষয়ে আলোচনা করবে। এছাড়াও অনুচ্ছেদ ১২-তে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, নদী-তীরবর্তী রাষ্ট্র যদি এমন কোনো উপায় অবলম্বন করে, যাতে করে অপর দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে, তখন তাকে যথাসময় এ ব্যাপারে অবহিত করবে। সঙ্গে বিবিধ বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি উপাত্ত ও তথ্যও সন্নিবেশিত করবে, যাতে করে সে রাষ্ট্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পরিমাণ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। অনুচ্ছেদ ২৭-এ পরিষ্কার বলা আছে, নদী-তীরবর্তী দেশগুলো এককভাবে বা যেখানে সম্ভব যৌথভাবে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে অপর নদী-তীরবর্তী দেশের কোনো ক্ষতি না হয়।
অনুচ্ছেদ ২৮-এ বলা হয়েছে, কোনো নদী-তীরবর্তী দেশ কোনো জরুরি অবস্থা বা সমস্যার সম্মুখীন হলে (মানবসৃষ্ট বা মানব কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের কারণে) দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার উদ্যোগ নিতে পারবে। যদি তারা কোনো চুক্তিতে পৌঁছতে অসমর্থ হয়, তখন good officeগুলোর সহায়তা বা অপর কোনো পক্ষের বা কোনো পানিসম্পদ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ও মধ্যস্থতা চাইতে পারে বা বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে প্রেরণ করতে পারে (অনুচ্ছেদ ৩৩)।
এ প্রসঙ্গে সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি রাজেশ সাহার মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি সম্মেলনের ফলাফল সমঝোতার মাধ্যমে গৃহীত না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ভারত ওয়ার্কিং গ্রুপে ৫, ৬ এবং ৭ খসড়া অনুচ্ছেদসংক্রান্ত ভোটকালে ভোটদানে বিরত থাকে। তিনি তৃতীয় পক্ষের সমঝোতার এবং অনুচ্ছেদে সংযোজন করারও বিরোধিতা করেন। এমনকি ভারত কার্যপদ্ধতি দলের ভোটের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। ১৯৯২ সালে হেলসিংকি সম্মেলনের সিদ্ধান্তমালা আন্তঃসীমা পানিসম্পদ নীতিমালার একটি মডেল হিসাবে পরিচিত। পরবর্তীকালে ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে হেলসিংকিতে এ সম্পর্কিত সাধারণ নীতিমালা গৃহীত হয় এবং ৩ বছরের এক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের জুন মাসে লন্ডনে এ দলিলের খসড়া অনুমোদিত হয়। হেলসিংকি সম্মেলনের সাধারণ নীতিমালার ভিত্তিতে স্পেন ও পর্তুগালের মাঝে সম্পাদিত পানিসম্পদের নিয়মতান্ত্রিক ও সর্বোচ্চ ব্যবহার চুক্তি এক উল্লেখযোগ্য সাফল্য। তদুপরি, হেলসিংকি চুক্তির আলোকে ১৯৯৫ সালের ৫ এপ্রিল কম্বোডিয়া, লাউস, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মাঝে স্বাক্ষরিত হয় Mekon River Basin Agreement I.
- ট্যাগ:
- মতামত
- আন্তর্জাতিক আইন
- পানি বণ্টন