ফেসবুক কহে যাহা সামাজিকগণ কহে তাহা
এ কথা আজ প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না যে ফেসবুক সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী। প্রিন্ট মিডিয়া মানে সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া মানে টেলিভিশন– এসবকে অতিক্রম করেছে ফেসবুক। ফেসবুকের ক্ষমতা অসীম। ফেসবুক অনেক তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদের নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় এবং একটি টেলিফোন সেটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে বিষয়টি চাউর হয়ে যায়। এর অনেক ইতিবাচক ফল আছে। কিন্তু মানব চরিত্রের মতোই তার মধ্যে রয়েছে অনেক নেতিবাচক দিক।
এত সহজলভ্য একটি মাধ্যম কখনো কখনো মানুষকে খুব সংকীর্ণ এবং ছোট করে ফেলে। সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে এই সোশ্যাল মিডিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই মাধ্যমটির আবার যান্ত্রিক পরিচালনায় থাকে নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে গেলে তার শক্তি আরও বেড়ে যায়। যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রের সম্পর্ক ভেঙে সে মানুষ হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। তার ক্ষোভ, যন্ত্রণা তখন রাজপথে সঙ্গীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই টেলিফোন সেটটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ক্যামেরা। সেই আগের ক্যামেরার মতো এত জটিল নয়, যেকোনো জায়গায় যেকোনো আলোতে বলতে গেলে ন্যূনতম আলো থাকলেই এটি ছবি এবং ভিডিও ধারণ করতে সক্ষম হয়। তাই শুধু কথা নয়, চিন্তার প্রকাশ নয়, সেই সঙ্গে একটি ছবি ও ভিডিও বিশাল এক ভাবনার বা বিদ্রোহের জন্ম দিতে পারে।
পৃথিবীর বড় বড় বিপ্লবে, গণ-অভ্যুত্থানে একটা উত্তেজনাকর মুহূর্ত থাকে। সেই মুহূর্ত কখনো প্রলম্বিত, কখনো সংক্ষিপ্ত। সেই মুহূর্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটে একটা পুরোনো শক্তির মধ্য দিয়ে। এই সময় ক্ষমতা জনগণের মধ্যে চলে আসে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তখন অচল ও দৃশ্যমান হয় না। এবারেও ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে তাই হয়েছে। কেউ কেউ সেই সঙ্গে কিছু বিশৃঙ্খল অভ্যুত্থানের মহিমাকে দারুণভাবে খর্ব করেছে। তাৎক্ষণিক এই উত্তেজনা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি তা ছড়িয়ে পড়ে নতুন আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়, তখন কিন্তু থমকে দাঁড়াতে হয়। কর্তৃত্ববাদ যখন অর্থ উপার্জনে বা অন্যের অধিকার হরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন পূর্ববর্তী শাসনের কথাই মানুষ মনে করে এবং ভীত হয়ে ওঠে। যে কর্তৃত্ববাদ দুর্নীতির জন্ম দেয়, দখলের জন্ম দেয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তার বিরুদ্ধেই মানুষের চিরায়ত প্রতিবাদ।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, সমাজের যেসব স্থানে আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের সম্মানবোধ দীর্ঘ সময় ধরে একেবারে নির্দিষ্ট করা আছে, সেইসব জায়গায় একটা নতুন ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে তা সবচেয়ে দৃশ্যমান। ছাত্ররা শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করিয়েছে। এ কথা অস্বীকার করব না যে কিছু শিক্ষক অবশ্যই শিক্ষাবান্ধব বা ছাত্রবান্ধব নন। সেখানেও প্রতিবাদ করার ভাষা আছে, কিন্তু তাঁকে দৈহিক বলপ্রয়োগ, অপমানিত করা একেবারেই সমীচীন বলে কেউ মনে করছেন না। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা বারবার এ কথা বললেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না—একেবারেই ধরাছোঁয়ার বাইরে, যেখানে কারও কর্তৃত্ব খাটে না।
মানুষের ভাবনা, বিবেক দ্বারা যা পরিচালিত হয়, একমাত্র সেই ফেসবুকে লেখালেখির স্বাধীনতাও অন্যের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এবং তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এ যেন যেকোনো কিছু লেখার জায়গা; তাতে কার ক্ষতি হলো, কার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হলো, সমাজের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল কি না—তা ভাববার অবকাশ নেই। এই ক্ষতিকর স্বাধীনতা অন্য ধরনের প্রবণতারও জন্ম দিয়েছে। যেমন, ইচ্ছেমতো মামলা দেওয়া, যেগুলোর আসামি এক শ, দুই শ, তিন শ কিংবা চার শ। এই ধরনের মামলা ক্ষোভ প্রকাশের একটা ব্যবস্থা হতে পারে, কিন্তু তাতে অভিযুক্তরা বেশ আনন্দের সঙ্গেই খালাস হয়ে যান।
একটা কথা কি আমরা মনে রাখব না যে, কোনো গণ-অভ্যুত্থান আমাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ নয়? অথচ এমনটাই ঘটছে ফেসবুকে এবং আদালতে। এর একটা ভয়াবহ রূপ আমরা দেখতে পাই সামাজিক আচরণে। সেই আচরণে আবার সেই পুরোনো প্রথা চলে এসেছে, যার নাম চাঁদাবাজি। পুরোনো চাঁদাবাজদের পরিবর্তে আমরা নতুনদের দেখতে পাই। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমে গেছে, ফুটপাতের দোকানিরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন; রিকশাচালক, সিএনজিচালক থেকে শুরু করে বাস-ট্রাকচালকেরাও উচ্ছ্বসিত হয়েছেন যে এখন আর তাঁদের চাঁদা দিতে হচ্ছে না। কিন্তু সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই প্রবণতাগুলো খুব খারাপভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। এ যেন অতীতেরই পুনরাবৃত্তি।