একদলীয় শাসন বনাম অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের আকাঙ্ক্ষা
একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনে রাষ্ট্র ও সমাজে যে দমবন্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা গত দেড় দশকে এ দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনার আদেশে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল একাকার হয়েছিল; তাঁর নির্দেশে বাঘ ও মহিষ এক ঘাটে জড়ো হওয়ার পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে আওয়ামী গোষ্ঠীবাজির অবর্ণনীয় উত্তাপে সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়। মানবাধিকার, ব্যক্তি ও বাক্স্বাধীনতা উপহাসের বিষয় হয়ে ওঠে, ব্যাংকের খোল বাকল ছিবড়ে দেশের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে সরকার লালিত লুটেরা গোষ্ঠী। চাকরি নাই, বেতনে-ব্যবসায় দিন চলে না; সাধারণ মানুষ নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে রাজপথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গর্জে ওঠা তারুণ্যের মিছিলে যুক্ত হয়ে মুক্তি খোঁজে। ভোটের অধিকার হারানো মানুষের সম্মিলিত ক্ষোভের বিস্ফোরণ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্তর্নিহিত শক্তি। এই শক্তিই ৫ আগস্ট মহাঅভ্যুত্থানে পরাক্রমশালী শেখ হাসিনার পলায়নের পর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করে। সরকারের এক মাস পূর্তিতে বলা যায়, ইতিবাচকভাবে নিজ দায়িত্বে এগিয়ে চলেছে।
আগের সরকারের মতো সরকারপ্রধান বা উপদেষ্টারা দিনভর টেলিভিশনে নিজেদের ছবি ও কথা প্রচারে ব্যস্ত নন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সংবাদমাধ্যমে প্রয়োজনীয় ও পরিমিত উপস্থিতি নিশ্চয়ই সংগত, আর সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ক্ষমতাচ্যুত সরকারপ্রধানের সংবাদ সম্মেলনে তথাকথিত গণ্যমান্য সাংবাদিকেরা তৈলবাজির যে ন্যক্কারজনক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন, ড. ইউনূসের দায়িত্বকালে তার নজির যে দেখা যাবে না– এটি গত এক মাসে স্পষ্ট। উপদেষ্টারাও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সংযত ও যথাযথ ব্যবহার করছেন।
ড. ইউনূস কম কথা বলেন, যা বলেন স্পষ্ট ও সরাসরি, তাঁর উদ্দেশ্য ও গন্তব্য তিনি অনায়াসে জানিয়ে দেন। অহেতুক নাটকীয়তার আশ্রয় না নিয়ে তাঁর অকপট সাহসী কথাবার্তা দেশের মানুষের সামনে আশার সঞ্চার করে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বৃহস্পতিবার দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বই বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে, নয়াদিল্লিকে অবশ্যই এমন বয়ান দেওয়া বাদ দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকে ইসলামপন্থি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইসলামপন্থি, বাকি সবাই ইসলামপন্থি আর তারা সবাই এ দেশকে আফগানিস্তান বানাবেন। বাংলাদেশ শুধু শেখ হাসিনার হাতেই নিরাপদ। এ বয়ান থেকে ভারতকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ অন্য যে কোনো দেশের মতোই আরেকটি প্রতিবেশী।’
এই ‘ইসলামপন্থি’ রাজনীতির বয়ান শুধু ভারতীয়দেরই নয়, দীর্ঘকাল বিরোধী মতের যে কাউকে জামায়াত-শিবির ও রাজাকার ট্যাগ বসিয়ে দেওয়া আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম প্রবণতা ছিল। ২০১৩ সালের পর আওয়ামী লীগ যখন একক নির্বাচন আয়োজনের পাঁয়তারা শুরু করে, তখন বিরোধীদের নির্বিচারে বিএনপি-জামায়াতের আগুনসন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনের সময় একই আচরণ আমরা দেখি। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মীয় জঙ্গিবাদী রাজনীতিতে দেশে অন্ধকার যুগ নিয়ে আসবে, এই প্রচারণা চলতেই থাকে।
বিএনপিসহ অনেক দল এ দেশে রাজনীতিতে সক্রিয় এবং যাদের তৃণমূলে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, যারা ইসলামকে আঁকড়ে ক্ষমতায় আসতে চান না– এই তথ্য সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে ড. ইউনূস বাংলাদেশের বহুত্ববাদী অসাম্প্রদায়িক সমাজকে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করলেন। ড. ইউনূস জানিয়ে দিয়েছেন, জুজুর ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে বোকা বানানো যাবে না। এ দেশে গণহত্যা চালিয়ে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ড. ইউনূস পিটিআইকে আরও বলেছেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত আনতে হবে। যে ধরনের নিষ্ঠুরতা শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন, তাতে এখানে সবার সামনে তাঁর বিচার করা দরকার।
গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের স্থানে স্থানে ধর্মীয় উপাসনালয় ও ভিটাবাড়িতে আক্রমণের সময় ড. ইউনূস সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, এ দেশে প্রত্যেক নাগরিকের মর্যাদা সমান। হিন্দু বা মুসলিম কারও প্রধান পরিচয় নয়, তার প্রধান পরিচয় সে বাংলাদেশের নাগরিক। তাঁর কথায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে এ দেশের মানুষের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষার অনুপ্রেরণা মেলে। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি বা রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে সমাজের মূলধারার বাইরে রাখা হবে না; রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার– এই প্রত্যয় কেবল সংবিধানের পাতায় না থেকে সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে চর্চার বিষয় হবে– এ চেতনাই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের মূল সোপান।
- ট্যাগ:
- মতামত
- একদলীয় শাসন
- অন্তর্ভুক্তি
- সমাজ গঠন