‘বদলে না যাওয়া’ বাংলাদেশ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সদ্য ভূমিষ্ঠ রাষ্ট্রের সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং স্বাধীনতার সরকারি ঘোষণাপত্র (প্রকলেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স) প্রকাশ করে। ঘোষণাপত্রে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় গণতন্ত্র, জনগণের ক্ষমতায়ন ও আইনের শাসনের অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। অঙ্গীকারটি কেবল কথার কথা ছিল না।
এর পেছনে দেশের স্বাধীনতাকামী নেতৃত্বের গভীর সংকল্প ও সদিচ্ছা ছিল। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে ওই সময় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা হলেও যুদ্ধ শেষ হওয়ার এক মাসের ভেতরেই তারা সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় ফেরত যায় (অন্তর্বর্তী সংবিধান আদেশ, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২)।
রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে অধিকতর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা সময় নিতে পারতেন। নতুন দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়নের জন্য অপেক্ষা করার অজুহাত দিতে পারতেন। ইচ্ছের সততায় (সিনসিয়ারিটি অব ইনটেনশন) তাঁরা সেটি করেননি। অন্তর্বর্তী সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় সরকারের চেতনা, আবহ ও কাঠামোর সুস্পষ্ট চিত্রায়ণ ছিল। এটিই ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে গৃহীত সংবিধানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রকাঠামোটি মোটা দাগে এমন—ব্রিটিশ রাজার আদলে দেশের প্রতীকী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং জনগণের রায়ে নির্বাচিত ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা নিয়ে দেশের নির্বাহী বিভাগ গঠিত (সংবিধানের চতুর্থ ভাগ)। জনগণের রায়ে নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে দেওয়া হয়েছে আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারের প্রাত্যহিক ও চূড়ান্ত জবাবদিহির দায়িত্ব (সংবিধানের পঞ্চম ভাগ)।
রাষ্ট্রীয় জীবনে সংবিধানের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রের আইনকানুন প্রয়োগে সরকারের ক্ষমতা চর্চার লাগাম টানা, জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দায়িত্ব পড়েছে বিচার বিভাগের ওপর (সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগ)। দেশের তৃণমূলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানের নির্বাহী বিভাগ অংশে উল্লেখ করা হলেও সেখানে কেন্দ্রের বা আমলাতন্ত্রের শাসনের বদলে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনের নিশ্চয়তা দিতে আলাদা অধ্যায় যোগ করা হয়েছে (সংবিধানের চতুর্থ ভাগ, তৃতীয় অধ্যায়)।
সরকার, সংসদ ও আদালতের বাইরে একেবারে আলাদা একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে তুলে ধরা হয়েছে (সংবিধানের সপ্তম ভাগ)। সংবিধানের অষ্টম ভাগে আলাদা করে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রের মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়কে। সংবিধানের নবম ভাগে দেশের জনপ্রশাসনে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও মৌলিক কিছু সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। আমলাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি কর্মকমিশনকেও আলাদা করে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে (নবম ভাগ, দ্বিতীয় অধ্যায়)। সংবিধানে সরকার, সংসদ ও আদালতের মতো বড় বড় তিনটি প্রতিষ্ঠানের পাশে এ চারটি তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠানকে এমন বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করাটা অর্থহীন কিছু নয়। সন্দেহ নেই, আমাদের স্বাধীনতার নায়করা দেশের তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত গণতান্ত্রিক শাসন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি বাছাই, রাষ্ট্রীয় তহবিলের জবাবদিহি এবং জনপ্রশাসন তথা আমলাতন্ত্রের রাজনীতি ও দলীয়করণমুক্ত থাকাকে এই পুরো কাঠামোর ভিত্তি বলে মেনেছেন।
সংবিধান প্রণয়নের ৫২ বছর পর পেছন ফিরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোটিকে দেখলে আমাদের কিছুটা বিষণ্ণতা গ্রাস করে। ৫০ বছরের এ যাত্রায় এ কাঠামোর অনেক বাঁকবদল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। আমরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের সরকার, জাতীয় দলকেন্দ্রিক রাষ্ট্রপতির সরকার, সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রপতির সরকার, নির্বাচনকালীন অনির্বাচিত সরকার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতামূলকভাবে কর্তৃত্ববাদী সংসদীয় সরকারব্যবস্থার ভেতর দিয়ে গেছি। এত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, আমাদের স্বাধীনতার নায়করা যে রাষ্ট্রকাঠামো বাতলে গেছেন, সেটির কঙ্কালসার অবয়বটিই কেবল অবশিষ্ট আছে। কাঠামোটির অন্তর্গত চেতনা, লক্ষ্য ও আদর্শ হারিয়ে যেতে বসেছে।