লাঠি না ভেঙে সাপ মারতে হবে
ব্যাংক খাতের আগুনে মনে হয় সরকার হাত দিয়ে ফেলেছে অথবা হাত দিয়ে যাচ্ছে। গত ২৯ তারিখের বিভিন্ন দৈনিক কাগজের খবর পড়ে অন্তত আমার তা-ই মনে হয়েছে। একটি কাগজের খবরের শিরোনাম : ‘তাদের (এস আলম গ্রুপ) সম্পদ বেচে টাকা তোলা হবে’। দ্বিতীয় একটি কাগজের খবরের শিরোনাম : ‘প্রভাবশালীরা কত ঋণ আত্মসাৎ করেছেন তার হিসাব হচ্ছে’। ‘আমানতকারীদের উদ্দেশে গভর্নর : যতটুকু অর্থ প্রয়োজন ততটুকুই তুলুন’। যুগান্তরের একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘এস আলমের মতো ব্যাংক লুটেরা পৃথিবীতে নেই’। এসব শিরোনাম পাঠ করার পর মনে হয় না আর কোনো আলোচনার দরকার আছে। তবু কিছুটা আলোচনা করতে হয় নিজেদের ‘বুঝের’ জন্য। বিষয়টি আসলে কী হতে যাচ্ছে? যুগান্তরের খবর ধরে যদি আলোচনা করি, তাহলে অনেক বিষয় সামনে আসবে। ‘বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে’-এ বিষয়টিই একটু বোঝার চেষ্টা করি।
আমরা জানি, আমানতকারীরা যখন ব্যাংকে টাকা রাখেন, তখন ব্যাংক চাহিদামাত্র ওই টাকা গ্রাহককে ফেরত দিতে বাধ্য। এখানে কোনো ওজর-আপত্তির সুযোগ নেই। শুধু ব্যাংকে যেতে হবে ব্যাংকিং সময়ের মধ্যে। এক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে টাকা আদায় করে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে-এ কথা কোনোভাবেই খাটে না। তাহলে ব্যাংক ব্যবসা চলবে না। ব্যাংকের ঋণ আদায় হোক বা না হোক, আমানতকারীদের টাকা ব্যাংক ফেরত দেবে। এই হচ্ছে নিয়ম। যদি কোনো ব্যাংক না দিতে পারে, তাহলে ওই ব্যাংক ‘লালবাতি’ জ্বালাবে। আমানতকারীরা পড়বে বিপদে। অবশ্য এর থেকে উদ্ধার করতে পারবে একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই ব্যাংককে টাকা ধার দিয়ে উদ্ধার করবে। এক্ষেত্রে মাননীয় গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘গ্রাহকদের বলব, ধৈর্য ধরুন। একবারে সবাই টাকা তুলতে যাবেন না। তাহলে কেউ টাকা নিতে পারবেন না। অনেকে অতিরিক্ত সুদের লোভে এসব ব্যাংকে টাকা রেখেছেন। এখন অধৈর্য হলে চলবে না। আমানতের টাকা লোকসান হোক, এটা আমরা চাই না। আমরা টাকা ছাপিয়ে কোনো আমানতের টাকা দেব না। কারণ সেটা জাতির জন্য ভালো হবে না।’
বলা বাহুল্য, এসব মন্তব্য বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। এবং সবার কাছে তা বোধগম্য হবে না। যখন বলা হবে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা তুলবেন না, তখনই প্রশ্ন উঠবে, কেন একথা বলা হচ্ছে? ব্যাংকে মানুষ টাকা রাখে এবং প্রয়োজনীয় টাকাই সবাই তোলে। বেশি তোলার কাজ কেউ করে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একথা বলা হলে ভুল সংকেতও বাজারে যেতে পারে। আমাদের দেশে এর আগে আরও কয়েকটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে অনেক ঘটনা ঘটেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা দিতে সাহায্য করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চোখ বুজে থাকেনি নিতান্ত বাস্তবতার কারণে-ব্যাংক খাতের ওপর জনগণের আস্থা ঠিক রাখার জন্য। এখন যদি বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘টাকা ছাপিয়ে’ কোনো ব্যাংককে সাহায্য করবে না, এর অর্থ কী কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও খোলাসা করে তা বলতে হবে। বস্তুত আমি বলতে চাই, গভর্নর সাহেবকে আরও সতর্কতার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি গভর্নর। একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একমাত্র গভর্নর। তার প্রতিটি কথা ‘লাইন বাই লাইন’ মানুষ ব্যাখ্যা করবে এবং তা ব্যাংক ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। অতএব...।
একটি ভালো খবর দেশবাসীর জন্য। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলা হয়েছে, ‘প্রভাবশালীদের টাকা আত্মসাতের হিসাব হচ্ছে।’ প্রভাবশালীদের মধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরাও আছেন। পরিষ্কার বোঝা যায়-ঋণখেলাপি, ঋণ পুনর্গঠনকারী (রিস্ট্রাকচারিং), বড় বড় উদ্যোক্তা, বড় বড় আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, ব্যাংকের মালিকদের একটা অংশই প্রভাবশালী এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে পড়বে। এর সংখ্যা বেশ হবে। এখানে প্রশ্ন, ‘অসাধু’ ব্যবসায়ী কে? আমরা কথায় কথায় বলি ‘একশ্রেণির ব্যবসায়ী’, ‘অসাধু ব্যবসায়ী’ ইত্যাদি। কিন্তু কেউ কখনো পরিষ্কার করে বলি না এরা কারা। কীভাবে একজনকে ‘অসাধু’ ব্যবসায়ী বলব? এর ক্রাইটেরিয়া কী? সকালে বিমানের যে টিকিট ১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়, বিকালে তা বিক্রি করা হয় ২০০ টাকায়-এটা কি অসাধু ব্যবসায়ীর লক্ষণ? অথবা ব্যবসা শুরু যার সামান্য টাকা দিয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে যিনি অনিয়মের মধ্য দিয়ে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছেন, তিনি কি ‘অসাধু’ ব্যবসায়ী? স্বাধীনতার পর অনেক ব্যবসায়ী হুন্ডি, চোরাচালান ব্যবসা, ভ্যাট ফাঁকি, কর ফাঁকি, গ্যাস চুরি, বিদ্যুৎ চুরি ইত্যাদি করে আজকের দিনে ২০-৩০টি কোম্পানির মালিক হয়েছেন, তিনি কি ‘অসাধু’ ব্যবসায়ীর মধ্যে পড়বেন? মুশকিল হচ্ছে, এ ধরনের ব্যবসায়ীরা আবার বহু লোকের চাকরির সংস্থানও করেছেন। প্রচুর আমদানি-রপ্তানিও করেন। দেশের ভালো-মন্দ শিল্প যা হয়েছে, তাও তাদের একাংশের মধ্য দিয়েই হয়েছে। ব্যাংকগুলো স্বাধীনতার পর থেকে ফাইন্যান্স করে ঋণখেলাপি যেমন তৈরি করেছে, তেমনি অনেক বড় বড় শিল্পমালিকও তৈরি করেছে। ভালো-মন্দ সবই আছে। এখন প্রশ্ন, ‘অসাধু’ ব্যবসায়ী কে বা কারা, তা নির্ধারণ করা হবে কীভাবে? এমন ব্যবসায়ী প্রকল্পের জন্য ঋণ পেয়েছেন, অথচ ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের অভাবে চালাতে পারছেন না। তিনি কি ‘অসাধু’ ব্যবসায়ী? এ অবস্থায় আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে।
বস্তুত ‘সাধু-অসাধু’ ব্যবসায়ীদের সমন্বয়েই দেশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের ওপর সবাই ক্ষিপ্ত। তাদের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। অথচ তারা দিনে দিনে এত বড় হয়েছে যে, তারা নিজেদের বড় বড় জাহাজে নিজেদের পণ্যই আমদানি করে। তারা হাজার হাজার কোটি টাকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে, বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারা চালের দাম; চিনি, সয়াবিন, পেঁয়াজসহ সব ভোগ্যপণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যাংক তাদের প্রচুর ‘ফিন্যান্স’ করে। প্রয়োজনে বিনা ‘মার্জিনে’ ‘এলসি’ খোলে। ‘ট্রাস্ট রিসিট’ ধরনের ঋণ সুবিধা দেয়। তারাই বাজার ঠিক রাখে। তারা খুবই প্রভাবশালী। বস্তুত তারা শুধু পণ্য আমদানিই করে না, দেশের পোশাকশিল্প, অন্যান্য শিল্প, ব্যাংক-বিমা ইত্যাদির মালিকও তারাই। এই মালিকদেরও আমরা বলব ‘সাধু’, কেউ বলব ‘অসাধু’। এবং ‘সাধু’, ‘অসাধু’ ব্যবসায়ী সম্পর্কে আমাদের সাধারণ একটা ধারণাও প্রচলিত আছে। যেমন-বড় বড় ঋণ এবং বেনামি ঋণের প্রশ্নটি যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে এ এক ভীষণ ঝামেলার বিষয়। বোঝা যায়, একটি কোম্পানির আসল মালিক ‘কলিমউদ্দিন’। কিন্তু কাগজপত্রে এবং আইনত ‘কলিমউদ্দিন’ ওই কোম্পানির ধারেকাছেও নেই। দেখা যাবে ‘কলিমউদ্দিনের’ ব্যবসা দিব্যি চালাচ্ছে ‘রহিমুদ্দিন’। রহিমুদ্দিনের নামে ট্রেড লাইসেন্স আছে, টিআইএন নম্বর আছে, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন আছে, কোম্পানির ‘মেমোরেন্ডাম অফ অ্যাসোসিয়েশন’ আছে, আছে ‘আর্টিকেল অফ অ্যাসোসিয়েশন’, ‘সার্টিফিকেট অফ ইনকরপোরেশন’ আছে। কাগজপত্রে ‘কলিমউদ্দিন’ কোথাও নেই। অথচ এটা তারই ব্যবসা। এমন ঘটনা অনেক। এরও কারণ আছে। বাজার অর্থনীতিতে মানুষ দুই হাতে টাকা বানায়-আইন মেনে বানায়, আইন ভেঙেও বানায়। তারা ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়ায়। ১ কোটি, ৫ কোটি, ১০ কোটি, ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। একইসঙ্গে তাদের ঋণের চাহিদা বাড়ে। অথচ এতে বাধা আছে। একজন ‘পার্টি’ এক ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ঋণ নিতে পারেন না। এর জন্য রয়েছে ‘সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার’। অর্থাৎ নিয়মমতো তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণের বেশি ঋণ পাবেন না। অথচ ব্যবসার জন্য তার টাকা দরকার। কী করবেন তিনি? বিরাট প্রশ্ন। আমি তাকে বড় হতে দিলাম, টাকা বানাতে দিলাম, অথচ ঋণ দেব না-আবার দেশে ক্যাপিটেল মার্কেট ‘মা-গুড়া’ হয়ে আছে। বাধ্য হয়ে ওই ব্যবসায়ী ‘দুই নম্বরি’ পথ ধরে। বেনামিতে কোম্পানি খোলে। দেশে এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা যে কত, তা কেউ জানে না। খুঁজে বের করতে হলে ‘গ্রাম উজাড়’ হয়ে যেতে পারে। বস্তুত এটি কঠিন কাজ। যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে, যথার্থ লোক নিয়োগ না দিয়ে এই ‘অসাধু’ ব্যবসায়ী খুঁজতে গেলে সমস্যা হতে পারে। যেমন ধরা যাক কিছু খবরের কথা। কাগজের খবর পড়ে মনে হয় বড় বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই সন্দেহের মধ্যে আছে-যথার্থই হয়তো আছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সুশাসন প্রতিষ্ঠা
- ব্যাংক খাত