গণতন্ত্রের জন্য চাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি

সমকাল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ১২:২৮

শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর দেশে এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিপুল জনআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র বলতে সবাই এক জিনিস বোঝেন না। কারও কাছে গণতন্ত্র হচ্ছে কেবল নির্বাচিত সরকার। কিন্তু নির্বাচিত স্বৈরাচার অনির্বাচিত স্বৈরাচারের চেয়ে উন্নত না-ও হতে পারে। বিশেষ করে সে যখন মনে করে, তার সব কাজের পেছনে লোকের  সমর্থন রয়েছে; কেননা সে বৈধ, ভোটের মধ্য দিয়ে এসেছে।


গণতন্ত্র বলতে জনগণের সরকার বোঝায় ঠিকই, কিন্তু ওই রকমের একটি সরকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় যদি রাষ্ট্র ও সমাজে গণতন্ত্র না থাকে। গণতন্ত্রের জন্য সেই রকমের রাষ্ট্র দরকার, যে রাষ্ট্র নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেবে; দেখবে যাতে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার ন্যূনতম প্রয়োজন থেকে কেউ বঞ্চিত না হয়। পাশাপাশি তেমন সমাজ আবশ্যক, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা শত্রুতার নয়, মৈত্রীর বটে। যেখানে পারস্পরিক সংহারের উন্মত্ত ব্যস্ততা নেই, রয়েছে সৌহার্দের উষ্ণ সহযোগিতা। দুর্বল যেখানে প্রবলের দ্বারা নির্যাতিত হয় না; সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। নাগরিকদের জন্য থাকে অধিকার ও সুযোগের সাম্য। তবে আজকের দিনে বিশ্বের নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, সমাজের চেয়েও বেশি শক্তি হচ্ছে সংস্কৃতির। সমাজ হলো আত্মরক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান; সংস্কৃতি আত্মবিকাশের ধারা। সমাজে মানুষ আশ্রয় খোঁজে; সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে মানুষ নব নব বিজয়ের প্রমাণ দেয়। সংস্কৃতির ইতিহাস পরিবেশ ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানুষের বিজয়ের ইতিহাস।


সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর দুর্যোগ প্রমাণ করে সংস্কৃতি কত বেশি শক্তিশালী। সেখানে শ্রমিকশ্রেণি পুরাতন রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু দুর্বলতা রয়ে গিয়েছিল এক জায়গাতে। সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ার ক্ষেত্রে। বিপ্লবের ঝড়ে পুরোনো সংস্কৃতির গাছটা পড়ে গেলেও তার শিকড় থাকে। অনুকূল আলো, হাওয়া, মাটি ও পানিতে সেই বিষবৃক্ষ আবার সতেজ হয়। ক্ষতির কাজ চলতে থাকে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণা থাকতে পারে; সকলের মধ্যে না থাকুক, এককালে যারা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিল তাদের মধ্যে তো থাকবেই। সমাজের পশ্চাৎপদ অংশের মধ্যে সামন্তবাদী পিছুটানও বাস্তবিক সত্য। মানুষ একটা সংস্কৃতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু যেমন তাকে হাঁটতে শিখতে হয় চেষ্টা করে, তেমনি ওই সংস্কৃতির ভালো গুণগুলোও অর্জন করতে হয় অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। মানুষ জন্মগতভাবেই স্বার্থপর। সেখানে সে একটি প্রাণী বটে, তার সামাজিক গুণগুলো বিকশিত হয় যত্নের ফলে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে ক্রমাগত শক্তিশালী করে তোলার কাজটির প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। তদুপরি একদিকে দেশের অভ্যন্তরে ঘটছিল আমলাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে বাইরে থেকে আসছিল পুঁজিবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসন। এরা উভয়েই সংস্কৃতির জন্য কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভয়াবহ ক্ষতির। আমলাতন্ত্র হচ্ছে যুগপৎ বৈষম্যের ফল ও কারণ। পার্টির নামে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছিল এবং সেই আমলাতান্ত্রিক বৈষম্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে পুষ্ট করে তুলেছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশে সমাজতন্ত্র জনপ্রিয়তা হারিয়েছে এই আমলাতান্ত্রিক বৈষম্যের কারণে। 



শুধু তাই নয়। পুঁজিবাদী সংস্কৃতি ক্রমাগত তথাকথিত উন্নত জীবনের আকর্ষণ প্রচার করছিল। নতুন প্রজন্ম তার মোহে পড়েছে। ভেবেছে, আমেরিকান হবে; রাশান থাকবে না। সাম্রাজ্যবাদ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত রেখেছে। ফলে একদিকে সুবিধা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দেশের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের, অন্যদিকে সম্ভব হয়েছে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখা। নইলে যে সমাজতন্ত্রীরা আকাশে আমেরিকানদের হারিয়ে দেয়, তারা মাটিতে হারাতে পারত না– এটা ঠিক নয়। সুযোগ পায়নি। ওদিকে আকাশপথে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এসে আক্রমণ করেছে মানুষকে। এ আক্রমণ সিআইএর তৎপরতার চেয়ে অধিক কার্যকর ছিল। যে জন্য সিআইএর এখন সমালোচনা করা হচ্ছে এই বলে যে, তারা এমনকি কী ঘটতে পারে তার পূর্বাভাসটি পর্যন্ত ঠিকমতো দিতে পারেনি। সরাসরি যুদ্ধ বাধালে আমেরিকা যা করতে পারত না, সাংস্কৃতিক অন্তর্ঘাতের সাহায্যে তা প্রায় অবিশ্বাস্য সাফল্যের সঙ্গে সম্ভব করে ফেলেছে। অবশ্য কাজটা চলছিল একেবারে শুরু থেকেই, এবং এটা তো মানতেই হবে যে মানুষের প্রাণী সত্তার কাছে যতটা সহজে আবেদন করা যায়, তার সামাজিক অনুভূতির কাছে আবেদন করা ততটা সহজ নয়। কখনও ছিল না, এখনও নেই।


শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো এই যে, উন্নত ব্যবস্থার জন্য একটি উন্নত সংস্কৃতি গড়ে তোলা চাই। সরকার, রাষ্ট্র, সমাজ– এর প্রতিটিই জরুরি ও শক্তিশালী, কিন্তু চূড়ান্ত কাজটা সংস্কৃতিই করে। কিংবা করে না। গড়ে কিংবা ভেঙে দেয়। গণতন্ত্রের জন্যও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রয়োজন। এই সংস্কৃতির প্রথম দাবি হচ্ছে, কুসংস্কার, অশিক্ষা, অদৃষ্টবাদ, সংকীর্ণতা এসব থাকলে গণতন্ত্র পাওয়া সম্ভব নয়। কেবল অসাম্প্রদায়িক নয়, হওয়া চাই ধর্মনিরপেক্ষ।


কিন্তু গণতন্ত্রের প্রাণ কোথায়, সেই সচেতনতাটি আরও বেশি প্রাথমিক। প্রাণ থাকে সাম্যে। সাম্য অর্থ এই নয় যে, সব মানুষ মেধা, ওজন, উচ্চতা অথবা চেহারায় সমান হয়ে যাবে। কেননা, সে ক্ষেত্রে আমরা কতগুলো প্রাণী কিংবা পুতুল পাব, মানুষ না পেয়ে। না; বৈচিত্র্য থাকবে। নানান ফুল ফুটবে ওই সামাজিক উদ্যানে। কিন্তু সব ফুলই ফুল হবে, ফুলের মর্যাদা ও অধিকার পাবে। অধিকারের সাম্য না থাকলে গণতন্ত্র আসে না, আসবার উপায় নেই। অধিকারের সাম্য নষ্ট হচ্ছে পুঁজিবাদের কারণে। এটা খুব সহজ কথা। কিন্তু এই কথাটাকে অস্পষ্ট করে তোলা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইচ্ছা করে, বাকি ক্ষেত্রে বেখেয়ালে।


গণমাধ্যমকে আমরা অনেক সময় প্রচারমাধ্যম বলি, অর্থাৎ বলতে বাধ্য হই। আসলে এরা সব সময়ই প্রচারমাধ্যম। যখন সরকারের মাহাত্ম্য প্রচার করে তখন আমরা ক্ষিপ্ত হই। কেননা, সেটা চোখে পড়ে। কিন্তু অন্য সময়েও, বস্তুত সব সময়ই এরা কারও না কারও মাহাত্ম্য প্রচার করছে। এরা মোটেই নিরপেক্ষ নয়। সর্বদাই কোনো না কোনো পক্ষের হয়ে কথা বলে। খবর প্রচার না করলেও আদর্শ প্রচার করে। আর আদর্শের প্রচার যেমন সূক্ষ্ম তেমনি গভীর। গণমাধ্যম নিরপেক্ষ থাকবে– এটা সম্ভব নয়; এ আমরা চাইবও না। আমরা চাইব এরা গণতন্ত্রের পক্ষে থাকুক। নিরপেক্ষ বেতার-টেলিভিশন নয়; জনগণের পক্ষের বেতার-টেলিভিশন দরকার, তেমনি দরকার গণমাধ্যমের।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও