বানভাসি: শিক্ষা সংস্কার ও মানবিক রাষ্ট্র
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে এক আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়েছে দেশের একাংশ। সাধারণত এই অঞ্চলে এ রকম বন্যা আগে কখনো দেখা যায়নি। ১৯৮৮ সালের বন্যায় রাজধানী ঘিরে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ডুবে গিয়েছিল। একদিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, অন্যদিকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত পানিতে থইথই হয়েছিল। নৌকা চলাচল করত এসব স্থানে। ঢাকার উপকণ্ঠ একেবারেই বানের পানিতে ভেসে গিয়েছিল। টিএসসিকে কেন্দ্র করে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
এবারের চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে স্বতঃস্ফূর্ততা আরও বেশি। মানুষ টাকাপয়সা, ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই ত্রাণকার্যে। টিএসসি এক সার্বক্ষণিক ত্রাণ কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়ে পড়েছে, ত্রাণকর্মীদের বিনিদ্র দিন-রাত্রির কেন্দ্র হয়ে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই ত্রাণকার্যক্রম আরও কিছুদিন চলবে।
বর্ষা মৌসুমে বন্যা আর শুকনো মৌসুমে খরা যেন আমাদের জীবনের একটা অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই যৌথ নদী কমিশন নানা ধরনের প্রস্তাব, কার্যক্রম এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করে আসছে। কিন্তু যথার্থ কোনো ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ভাটি অঞ্চলের মানুষ হিসেবে আমরা বানভাসিকে জীবনের একটা ভবিতব্য বলেই মেনে নিয়েছি। এই আকস্মিক বন্যা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।
অন্য একটা সংকট হচ্ছে—চাকরিজীবীদের নানা দাবি-দাওয়া এবং দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করা। প্রতিদিনই এ নিয়ে কিছু ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে মনোযোগ দেওয়ার ব্যাপারটিতে সরকার পিছিয়ে পড়ছে। চাকরি স্থায়ীকরণের বিষয়টি এত সহজ নয়। এর সঙ্গে অর্থ বরাদ্দের বিষয় জড়িত।
এর মধ্যে এসেছে নতুন একটা বাড়তি চাপ। পুলিশ এখনো পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারেনি। অন্য নানা ধরনের মামলার ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকছে আদালতপাড়া। রাষ্ট্রপক্ষের কিছু মামলা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু দলীয় আক্রোশবশত মামলার সংখ্যাই বেশি। কিছু নিরীহ অভিনেতা ও খ্যাতিমান ক্রিকেটার হত্যাচেষ্টা মামলায় পড়ে যাচ্ছেন। এসব মামলাও সেই ২০১৫ সালের। এতে যেমন শিল্পী-ক্রিকেটাররা আতঙ্কিত হচ্ছেন তা-ই নয়, আইনজ্ঞরা বলছেন, এই সব মামলা একধাপও অতিক্রম করতে পারবে না।
আমাদের উচিত অন্তর্বর্তী সরকারকে নানাভাবে সহযোগিতা করে একটা স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা। যেমন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল অতিদ্রুত চালু হয়েছে। মানুষ তাই সেবা গ্রহণ করতে পারছে। যখন পুলিশ ছিল না, তখন নাগরিকেরা নিজেরাই পাহারা দিয়েছে। মন্দির পাহারা দিয়ে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিক্ষা—যে ছাত্ররা এত বড় একটা অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করল, তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। কিন্তু কোথা থেকে যেন একটা রব উঠল, ‘পদত্যাগ’। শিক্ষার্থীদের দেখা গেল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্র পদত্যাগের জন্য ভূমিকা গ্রহণ করতে। সেই ভূমিকায় দেখা গেল অসহিষ্ণুতা এবং এতে করে যেন ছাত্র-শিক্ষকের সংস্কৃতির বিনাশ হতে চলেছে। কোনো কোনো স্কুলে প্রধান শিক্ষিকাকে বেঁধে রেখেছে শিক্ষার্থীরা, কোথাও জোর করে চেয়ার থেকে টেনে নামানো হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্রযুক্তির কল্যাণে ছবি তুলে তা ফেসবুকে আপলোডও দিয়ে দিচ্ছে এবং অন্য শিক্ষার্থীরা এতে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এ ঘটনার তীব্রতায় অনেক ভালো শিক্ষক ভয়ে পদত্যাগ করছেন অথবা এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকের ছাত্র হিসেবে আমার এবং শিক্ষা উপদেষ্টার গভীর উদ্বেগের বিষয়—যে শিক্ষককে আমরা পিতার চেয়েও বড় জায়গায় স্থাপনে অভ্যস্ত, সেই শিক্ষককে অপদস্থ হতে দেখে খুবই মর্মাহত হচ্ছি। যদিও এ কথা সত্য যে সেই সময়ের মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক এখন হয়তো সেভাবে সবাই নন। কিন্তু তারপরও এই সময় শিক্ষার্থীদের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতাটা জীবনের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই ঘটনাবলি শিক্ষাব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।
এখনই দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে বাড়তি কার্যক্রম শুরু করা জরুরি প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীরা একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে, রাজপথে প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করেছে, এখন ত্রাণকার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে—এসব ভালো ভালো উদাহরণ তৈরি করার পর যদি শিক্ষার সংস্কৃতিটা বুঝতে না পারে, তাদের বোঝানোর দায়িত্বটা আমাদের। ছাত্রদের অতিদ্রুতই শিক্ষাকার্যক্রমে ফিরিয়ে নেওয়া দরকার। বইয়ে মনোযোগ দেওয়াও শিক্ষার্থীদের জন্য একটা কঠিন কাজ। কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল একটা প্রজন্ম শিক্ষার প্রতি আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্লাসে পড়া হচ্ছে না; অথচ শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন এবং শিক্ষাকার্যক্রমও পরিবর্তন করা হচ্ছে না। অটোপাসে অধিকাংশ শিক্ষার্থী খুশি হচ্ছে। এটা তো শিক্ষার ওপর অশনিসংকেত!