মব সৃষ্টি করে নৈরাজ্যের অবসান হোক
দেশব্যাপী প্রবল ছাত্র-জনতা গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনা দেশান্তরি হওয়ার পর প্রায় তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হতে চলেছে। কিন্তু সেই ৫ আগস্ট থেকে যে নৈরাজ্য ও অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, তার অবসান এখনো হয়নি।
রাজপথে অবশ্য যান চলাচলে নৈরাজ্য ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা এখন আর চোখে পড়ছে না। সব নৈরাজ্য ও অস্থিরতা এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয়। এ ছাড়া কিছু অস্থিরতা রয়েছে শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফ থেকে এই সব নৈরাজ্য ও অস্থিরতা বন্ধ করার বিষয়ে কোনো কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি না। যদিও আমরা সবাই জানি যে তাঁরা কাজ করছেন।
কাজ তো তাঁরা করবেনই। রাষ্ট্র সংস্কারের মতো অনেক বড় ও দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ একটি কাজ সম্পন্ন করার জাতীয় দায়িত্ব তাঁদের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। সে কাজে তাড়াহুড়ার কোনো সুযোগ যে নেই তা-ও আমরা বুঝি এবং মানি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় দুই সপ্তাহ পর সচিবালয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সরকারি অফিস ভবনের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে হট্টগোল করা, সেখানকার একটি ভবনের ১৮ তলায় গিয়ে একজন সচিবের কক্ষে সদলবলে ঢুকে পড়া এবং এই হট্টগোল সৃষ্টিকারীদের চাপের মুখে অসমাপ্ত এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া মেনে নেওয়া যায় না। এটি মোটেই ভালো আলামত নয়।
অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো পর্যায় থেকে এই হট্টগোল সৃষ্টির বিষয়ে এমন কোনো বক্তব্য আমরা পেলাম না যে মব (সংঘবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল জনতা) সৃষ্টি করে এ ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি আর বরদাশত করা হবে না। কিংবা এখন থেকে কোথাও আর কেউ যেন এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলো।
এমন একটি ঘোষণা দিলে অন্তর্বর্তী সরকার কি স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগে অভিযুক্ত হতো? তাই যদি হয়, তাহলে এ সরকার কাজ করবে কীভাবে? তা ছাড়া এখন যারা অটোপাস প্রত্যাখ্যান করে পরীক্ষা নেওয়ার দাবি তুলেছে, তাদের সরকার কী বলবে? সাধারণ ও সুস্থ জনমত তো তাদেরই পক্ষে বলে মনে হচ্ছে। এখন তারাও যদি মব সৃষ্টি করে, তাহলে কি আবার পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে?
সেদিনের সচিবালয়ের ওই ঘটনায় আরও একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ সংঘবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল জনতার কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করার জন্য আইন প্রয়োগে এখনো প্রস্তুত নয়। এমনকি সচিবালয়ের মতো সরকারি স্থাপনা রক্ষায়ও নয়। যদি হতো তাহলে গেট ভেঙে সচিবালয়ে ঢুকে পড়ার মতো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হতে পারত না।
অবশ্য জুলাই-আগস্টের প্রবল ছাত্র-জনতা গণ-আন্দোলনে জনতার রোষানলে সবচেয়ে বেশি পড়েছে পুলিশ। তাদেরই সব সময় সামনে দাঁড়াতে হয়। তাই তাদের মধ্যকার ট্রমা এত সহজে অপসৃত হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষের নির্দেশও তাদের কাজের জন্য জরুরি। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো যদি বিভিন্ন পর্যায়ে মব সামলানোর জন্য কঠোর হতে না চায়, তাহলে সে দায়িত্ব অন্তত আরও কিছুদিনের জন্য ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থানের সংগঠক সমন্বয়কদের ওপর অর্পণ করতে পারে। তাঁরা তো প্রস্তুত আছেনই। আমার মনে হয় তাঁরা যথাযথভাবেই এই দায়িত্ব সামলাতে পারবেন।
আরেক ধরনের মব সৃষ্টি করা হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি অফিসে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই এ ধরনের কিছু মব সৃষ্টির ঘটনা আমরা দেখেছি সচিবালয়ে; বিশেষ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। ওখানে যাঁরা গিয়েছিলেন তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে অন্যায়ের শিকার। সে হিসেবে তাঁদের দাবি ন্যায্য। সেই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা সেখানে গিয়ে কিছুটা হইচই করেছেন, যা দীর্ঘদিনের বঞ্চনাজনিত আক্রোশের ফল। কিন্তু তাঁরা জনপ্রশাসন সচিবকে জোর করে বাধ্য করেননি, তখনই তাঁদের সবাইকে বহাল করার। জনপ্রশাসন সচিব যখন তাঁদের বলেছেন যে ফাইলপত্র দেখে সবার বিষয়ই ফয়সালা করা হবে, তখন কিন্তু তাঁরা নিবৃত্ত হয়েছেন।
কিন্তু আমরা ভিন্নতর ঘটনা দেখলাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। সেখানে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার উপস্থিতিতে নবনিযুক্ত মহাপরিচালককে তখনই (অন দ্য স্পট) বরখাস্ত করার জন্য মব সৃষ্টি করা হয়, যেটা কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর আচরণ হতে পারে না। কিন্তু তা করা হচ্ছে। অথচ সরকারের কোনো বক্তব্য কিংবা নির্দেশ-নির্দেশনা নেই।