কোন দিকে যাচ্ছি আমরা?
বড় বিপন্ন, বড় অবক্ষয়ের সময় পার করে ছাত্র-জনতার বিজয় এল। নিঃসন্দেহে ১৬ বছরের গণতন্ত্রহীন-স্বৈরনীতি শাসনের বিরুদ্ধে বিজয় এটি। একদিন যাদের ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, জনগণের ন্যায়সংগত দাবিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে, সেই গণমানুষের জয় এটি। এটাই প্রমাণিত হয়েছে, জনগণই দেশের মালিক। জনগণের শক্তিই বড় শক্তি। ক্ষমতা কখনো স্থায়ী নয়, জোর করে টিকে থাকা যায় অনেক দিন, কিন্তু জনরোষ থেকে শেষ অবধি বাঁচা যায় না, শেখ হাসিনার করুণ বিদায়ের মাধ্যমে এ সত্য অনিবার্য হয়ে উঠল আবারও।
প্রশ্ন হলো, কোন দিকে যাচ্ছে দেশ, ধোঁয়াশা আছে, অস্পষ্টতা আছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের মৌলনীতি হাতছাড়া হওয়ার বিরাট বিপদের দিকে যাচ্ছি না তো আমরা? পরিবর্তনের যে রাজনীতির কথা বলছি, সেখানে এটা আমাদের কোনোভাবেই কাম্য নয়। সমাধানযোগ্য একটি সমস্যাকে আগলে রেখে শুধু চরম অসহিষ্ণুতা, একগুঁয়েমি আচরণ, ক্ষমতার দম্ভ, জনগণের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থা কীভাবে সহিংস পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, কয়েক বছর ধরে তার চেহারা দেখেছি। তার প্রতিফলনে অদূর ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, জানি না।
কোনো আন্দোলনে পরস্পর বিপরীত দুই শক্তির লড়াই হয়। এ ক্ষেত্রে আন্দোলনের রূপ কোনো এক পক্ষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। প্রধানত, নির্ভর করে নিপীড়িত যার বিরুদ্ধে লড়ছে, তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তার ওপর। এটা সত্য, পৃথিবীর ইতিহাসে সহিংস রক্তাক্ত পথ শাসকেরাই তৈরি করেছে, এতে করেই শাসকেরা শেষ পর্যন্ত গদি থেকে নামে এবং নতুন কিছুর সূচনা হয়। শাসকের স্বৈরনীতি এত উগ্র হয়, তাতে ক্রমাগত দমন-পীড়ন মাত্রা বাড়াতে থাকে, আর মানুষ নিপীড়িতের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়। তবে কি নিপীড়িতরা সহিংস হবে? সোজাসাপ্টা উত্তর হলো ‘না।’ সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রধান রূপ হিসেবে যাঁরা সহিংসতাকে বিচার করেন, তাঁরা স্বভাবজাতভাবেই সহিংস?
আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ চেয়েছিলাম, এর বেশি কিছু নয়। জনগণ কখনোই ক্ষমতার জন্য ছিল না। তারা ক্ষমতার পালাবদলে অংশীজন হতে চেয়েছিল। পাকিস্তান আমলে একটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ছিল, সেটা দূর করতে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে, বিশেষ করে সামাজিক বৈষম্য রয়ে গেল, এখানে যত অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, তত বৈষম্য বেড়েছে।
মধ্যবিত্তের সেন্টিমেন্ট খুব খারাপ, একবার সেখানে ‘ঘা’ লাগলে, সেটা সারানো খুব কঠিন। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক—সব দিক থেকে রাষ্ট্র ‘অকার্যকর’ অবস্থায় নিমজ্জিত হয়েছে। সেটাই একটা গভীর ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় যে অভ্যুত্থান হয়েছে, সেদিকে এই আন্দোলন অগ্রসর হচ্ছে কি না, এটা ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেই পরিষ্কার হয়েছিল।
ঘৃণা এবং মেরুকরণের রাজনীতি অর্থনৈতিক ভিত্তির ক্ষতি করছে। বাক্স্বাধীনতা যত খর্বিত হয়েছে, ততই বিজ্ঞানকে পেছনে ঠেলে দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ-রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ তার জায়গা দখল করছে। এর পরিবর্তন দরকার। কিন্তু আন্দোলনকে তরুণেরা যেভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে, এই মেজাজটা এখন অন্য কথা বলছে, ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।