কেবল একজনকে সরিয়ে আরেকজনকে লঙ্কায় বসালে চলবে না
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ফ্রেন্ডস অব আর্থ ইন্টারন্যাশনাল এবং আইইউসিএনের নির্বাহী সদস্য। ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক, পরের বছর স্নাতকোত্তর এবং ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আইজেনহাওয়ার ফেলোশিপ সম্পন্ন করেন। পরিবেশবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে জাতীয় পরিবেশ পদক, ২০১২ সালে র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০০৯ সালে ‘পরিবেশের নোবেল’খ্যাত গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজে ভূষিত হন তিনি। ২০০৯ সালে টাইম সাময়িকী তাঁকে হিরোজ অব এনভায়রনমেন্ট খেতাবে ভূষিত করে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর উদ্যোগের জন্য তাঁর নেতৃত্বাধীন বেলা সম্মানজনক ট্যাঙ্গ পুরস্কার লাভ করে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের জন্ম ১৯৬৮ সালে, ঢাকায়।
সোমবার রাতে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আপনি বলেছিলেন, দম বন্ধ করা পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। কেন দম বন্ধ পরিস্থিতি ছিল?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: দম বন্ধ করা ছিল; কারণ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শাসনামলে ভিন্নমতের প্রতি কোনো সম্মান ছিল না। আমরা দেখেছি, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে আনসার পর্যন্ত সব বাহিনীকে সরকার তার দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণকে নিরাপত্তা দেবে; অবৈধ বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে; সেখানে তারাই অবৈধ আটক তো হরদম করে গেছে। তারা অপহরণ, গুম, খুনের মতো অপরাধও নির্বিচারে করে গেছে শুধু একটি নির্দিষ্ট সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে। তা ছাড়া অন্য যেসব জায়গায় মানুষ যাবে সরকারের অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইতে, যেমন বিচার বিভাগ, সংবাদমাধ্যম, সেসব জায়গায়ও সরকার আধিপত্য বিস্তার করেছিল।
বিচার বিভাগেও যাওয়া যেত না? আপনি নিজেও অনেকবার প্রতিকার চাইতে বিচার বিভাগে গিয়েছেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমি চাইলেও রামপাল তাপভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপারে হাইকোর্টে গিয়ে কোনো আদেশ পেতাম না, যদিও সব কাগজপত্রই আমার পক্ষে থাকত। আর কতকগুলো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সব দুর্নীতির ব্যাপারে বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার জন্য যেত না। শুধু বিচার বিভাগ নয়; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও প্রতিকার চাইতে যাওয়া যেত না। কারণ ওদের পক্ষেই সিস্টেমটা ডেভেলপ করা হয়েছিল, বাকি জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। বাকি জনগোষ্ঠীর কেউ কথা বললেই দমন-পীড়ন বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। জনস্বার্থের কোনো বার্তা সরকারের কাছে পৌঁছাবার কোনো উপায়ই ছিল না। সরকার যেভাবে প্রতিটি বিষয় দেখতে চাইত, তার বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সংবাদমাধ্যমের সামনে ছিল না। সাধারণ নাগরিকের তো প্রশ্নই আসে না।
আপনি ব্যক্তিগতভাবে দম বন্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন কীভাবে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আইনজীবী হিসেবেই আমি যখন প্রতিকার পেতাম না; সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি চিন্তা করে আমার দম বন্ধ লাগত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ হয়ে যেভাবে দমন-পীড়ন করত, সেটা বিশেষভাবে দম বন্ধ লাগত। বিচার বিভাগের অসহায়ত্ব দেখে আইনজীবী হিসেবে আমার বিশেষভাবে অসহায়ত্ব লাগত। প্রতিকারহীনতায় দম বন্ধ লাগত।
আপনি সিস্টেমের কথা বলছিলেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন ব্যক্তির বদলের মধ্য দিয়ে কি সিস্টেমেও পরিবর্তন আসবে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: যে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে বা যে দল ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে, তারা সিস্টেমটা এমনভাবে সাজিয়েছিল, প্রথম ব্যক্তি থেকে শেষ ব্যক্তি পর্যন্ত চরম অনুগত। তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী না হয়ে দলীয় কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছে। এখন যে সরকার ব্যবস্থার কথাই বলুন না কেন, মেনে নিতে হবে যে এই সিস্টেম পরিবর্তন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কেবল নির্বাচন উপহার দেওয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হলেই তো হবে না; সিস্টেমের সংস্কার করে যেতে হবে। কারণ আজকে আওয়ামী লীগ সরকার গণরোষে চলে গেছে। ২০০৮ সালেও কিন্তু আরেক সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে রাস্তায় নামতে হয়েছিল। সেই সরকারও কিন্তু জনসমাদৃত হয়ে বিদায় নেয়নি। তার মানে, সিস্টেম এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে সরকারের গোষ্ঠীস্বার্থ, ওদের অর্থনৈতিক স্বার্থ, ওদের ন্যস্ত স্বার্থে ব্যবহৃত হয়; জনগণের স্বার্থে ব্যবহৃত হয় না। নতুন যে সরকার আসবে, তার দায়িত্ব কেবল একজনকে সরিয়ে আরেকজনকে লঙ্কায় বসিয়ে দেওয়া নয়। সিস্টেমকে সেট করে দিতে হবে।
সেটা কোন প্রক্রিয়ায়?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: সিস্টেমটা আবার যেহেতু রাজনীতিকদের হাতেই যাবে; চেক অ্যান্ড ব্যালান্সটা তৈরি করে দিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সব রাজনৈতিক দলের সমঝোতার ভিত্তিতে আইন ও সংবিধান সংশোধন করার লিখিত চুক্তির মাধ্যমে করে যেতে হবে। কারণ সংসদ ছাড়া তো সংবিধান ও আইন পরিবর্তন করা যাবে না। এই সময়টুকু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে জনমত ভালোভাবে যাচাই করার জন্য আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, সংবাদমাধ্যম– সবার মতামত নিয়ে পরিবর্তনের রূপরেখা চূড়ান্ত করতে হবে। তার পর সেটার ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি আনতে হবে।