নিজেরা বাঁচতে সুন্দরবন বাঁচাতে হবে
এবার রিমালের থাবা থেকেও আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে সুন্দরবন। না হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ত। একইভাবে ২০০৭ সালের সিডর এবং ২০০৯ সালের আইলার মতো বড় বড় ঘূর্ণিঝড়েও সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঢাল হয়ে আমাদের অনেক জীবন ও সম্পদ বাঁচিয়ে দিয়েছে। সুন্দরবন থাকায় সে সময় আইলার বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার এবং জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ৪ ফুট কমে গিয়েছিল। সিডরের কারণে তখন সুন্দরবনের প্রায় ২১ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন, সুন্দরবনের এই ক্ষতি সহজে পূরণ হবে না। কিন্তু সুন্দরবনকে সুন্দরবনের মতো থাকতে দেওয়ায় শিগগিরই সেই ক্ষতি কাটিয়ে সুন্দরবন আবার আগের রূপে ফিরে আসতে পেরেছিল।
এটাই প্রকৃতির শক্তি। বরং ঝড়ে সুন্দরবনের উপকারই হয়েছিল। এক প্রতিবেদনে তখন বলা হয়েছিল, ঝড়ের পর সুন্দরবনে চারা গজানো এবং তা থেকে পরিণত বৃক্ষে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, সিডর ও আইলার আঘাতে অনেক পুরোনো ও বড় বড় গাছ ভেঙে গিয়েছিল। এতে আলো-বাতাস পেয়ে ছোট ছোট নতুন গাছের দ্রুত বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ভাঙা গাছপালা কেটে না সরানোর ফলে সেগুলো পচে মাটিতে পুষ্টি যোগ করেছিল। তা ছাড়া সেগুলো কেটে সরাতে গেলে মানুষের পদচারণায় ছোট ছোট চারা ও সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের যে ব্যাঘাত ঘটত, তা হয়নি। ফলে সুন্দরবনের পুনরুজ্জীবন আশাতীতভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই সম্ভব হয়েছিল। এখান থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। সুন্দরবনের যা ক্ষতি করার তার অধিকাংশই মানুষ করছে, প্রকৃতি সেসব ক্ষতিপূরণের চেষ্টা নিজেরাই করছে, মানুষদের যাতে ক্ষতি না হয় সে জন্য। উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় ২ কোটি মানুষ নানাভাবে সুন্দরবনের কাছে ঋণী। সুন্দরবন নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যুগ যুগ ধরে আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নানাভাবে সাহায্য করে আসছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রাকৃতিক কারণের চেয়ে মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই সুন্দরবন তথা ম্যানগ্রোভের বেশি ক্ষতি হচ্ছে।
দিনে দিনে সুন্দরবনের আয়তন কমছে। শুধু যে বনের আয়তন কমছে তা নয়, বনের ভেতরে থাকা গাছের ঘনত্বও কমছে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৫৯ সালে যেখানে সুন্দরবনে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব ছিল ২৬০টি, সেখানে ১৯৯৬ সালে হয়েছে ১৪৪টি। গাছের ঘনত্ব হ্রাসের পাশাপাশি লম্বা গাছের পরিমাণও কমছে। সুন্দরীগাছ এগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে দীর্ঘদেহী গাছ কমে যাচ্ছে, গাছে রোগ দেখা দেওয়ায় বয়স্ক গাছ মরে যাচ্ছে। ম্যানগ্রোভ বন হ্রাসের কারণগুলোর মধ্যে গবেষকেরা কয়েকটি কারণকে প্রধান বলে চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো—সুন্দরবনের জমি কৃষিজমিতে রূপান্তরিত হওয়া, বিশেষ করে ফসল চাষ, চিংড়ি চাষ, মানুষের ঘরবাড়ি ও রাস্তার জন্য বনের জমি চলে যাওয়া, সুন্দরবন থেকে নানা প্রয়োজনে গাছপালা কাটা, গবাদিপশু চারণ করা, মাছ ধরা ইত্যাদি। মনুষ্যসৃষ্ট এসব কর্মকাণ্ড আগের তুলনায় বর্তমানে বেড়ে গেছে। এ ছাড়া পরিবেশদূষণ বেড়েছে, স্বাদু পানির লভ্যতা কমেছে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বেড়েছে, পলি সঞ্চয়ন কমেছে, উপকূলীয় ভূমিক্ষয় বেড়েছে।
এসব কারণের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে স্বাদু পানির প্রাপ্যতা কমে যাওয়া এবং পলি মাটি কম জমা হওয়া। ১৯৭৫ সালে ভারতে পদ্মা নদীর উজানে ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার কারণে এ ঘটনা শুরু হয়েছে। ফলে নদীতে স্বাদু পানির প্রবাহ বা প্রাপ্যতা কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রতিবছর গড়ে ১ শতাংশ হারে সুন্দরবনের আয়তন কমছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, যেভাবে এবং যে হারে সুন্দরবন কমছে বা ছোট হচ্ছে, সেই ধারা ও হ্রাসের হার অব্যাহত থাকলে আগামী ১০০ বছর পর সুন্দরবন হয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবে।
ম্যানগ্রোভ বন আমাদের পরিবেশ রক্ষা, সেবা ও দরকারি বনজ সম্পদ সরবরাহে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের সমগ্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মিলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে বছরে প্রায় ২৬ মিলিয়ন টন কার্বন পরিশোষণ করে, যা আমাদের পরিবেশকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। সাধারণ বনের চেয়ে ম্যানগ্রোভ বনের কার্বন পরিশোষণের হার প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। শুধু বায়ু শোধন নয়, পানি শোধনেও ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ভূমিকা রাখে। মানুষের ক্রিয়াকর্মের দ্বারা ইতিমধ্যে আমরা বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ হারিয়ে ফেলেছি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ম্যানগ্রোভ
- সুন্দরবন রক্ষা