শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা রাস্তায়, সরকার কোথায়
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকনেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে কোনো ফারাক দেখিনি। এবারই প্রথম তাঁরা মুখোমুখি অবস্থানে। নব্বইয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর একযোগে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা লাগাতার ধর্মঘট করেছেন, এ রকম নজির নেই। ২০১৫ সালে নতুন বেতন বোর্ডের অসংগতি নিয়ে তাঁরা একবার আন্দোলন করেছিলেন। পরে আলোচনার মাধ্যমে সে সমস্যার সমাধান হয়।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কয়েকজন শিক্ষক গ্রেপ্তার হওয়ার পরও শিক্ষকেরা ধর্মঘটে যেতে সাহস পাননি। ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি হলেও সরকার-সমর্থক শিক্ষকেরা বলতেন, বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য তাঁরা মাঠে নামতে পারেন না। আগে শিক্ষক সমিতিতে একটা ভারসাম্য ছিল। দুই পক্ষের শিক্ষক প্রতিনিধি সমিতির নির্বাহী কমিটিতে থাকতেন। কিন্তু গত ১৫ বছরে শিক্ষক নিয়োগে এতটাই দলীয়করণ ও আত্মীয়করণ হয়েছে যে সর্বক্ষেত্রে সরকার-সমর্থকদের জয়জয়কার। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপিপন্থী শিক্ষকেরা নির্বাচন করতেও ভয় পান।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয় চালু করার প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের এবং কথিত বিপক্ষের সব শিক্ষক লাগাতার আন্দোলন করছেন। প্রথমে তাঁরা সভা-সমাবেশ ও স্মারকলিপি পেশ করেছেন। আংশিক কর্মবিরতি পালন করেছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ১ জুলাই থেকে কর্মবিরতিতে আছেন। ক্যাম্পাসে তাঁরা সভা-সমাবেশ অব্যাহত রেখেছেন। শিক্ষকনেতাদের দাবি, প্রত্যয় স্কিম বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
উল্লেখ্য, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় সরকার বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪০৩টি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রত্যয় স্কিম চালু করেছে। এ ক্ষেত্রেও সরকার কেন বৈষম্যমূলক নীতি নিল, তা আমাদের বোধগম্য নয়। প্রত্যয় স্কিমের লাভালাভ হিসাব না করেও যে প্রশ্ন তোলা জরুরি, সেটি হলো সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এক বছর পর কেন আলাদা স্কিম হবে?
এদিকে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিলের দাবিতে। সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য এক রকম নীতি নিয়েছে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য অন্য রকম নীতি। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা কোটা পুরোপুরি বাতিলের দাবি জানাননি। তাঁরা সংস্কার চেয়েছিলেন। কেননা ৫৬ শতাংশ কোটা অন্যায্য ও অযৌক্তিক। শিক্ষকেরা যেহেতু কর্মবিরতি পালন করছেন, সেহেতু শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে হয়নি। তাঁদের আন্দোলন ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে এখন রাজপথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দিয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে মহাসড়ক অবরোধ করছেন। সে ক্ষেত্রে ক্ষতিটা কেবল শিক্ষার নয়, অর্থনীতিরও।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রোববার ‘বাংলা ব্লকেড’ পালনের পর সোমবারও একই কর্মসূচি পালন করে। দেশে বর্তমানে যে ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে, তার কোনোটিতে ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে না। কর্মচারীরাও অফিস করছেন না। সেই অর্থে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা এখন স্থবির। কবে নাগাদ এই অচলাবস্থা কাটবে, কেউ বলতে পারে না। শিক্ষকেরা বলেছেন, দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। শিক্ষার্থীরাও বলেছেন, কোটাপদ্ধতি বাতিল না করা পর্যন্ত তাঁরা রাজপথে থাকবেন।
আগে আমরা দেখতাম, শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে শিক্ষকেরা অন্তত নৈতিক সমর্থন জানাতেন। আবার শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির প্রতিও শিক্ষার্থীরা সংহতি প্রকাশ করতেন। কিন্তু এই প্রথম ক্যাম্পাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেও কেউ কারও পাশে দাঁড়াননি; অন্তত শিক্ষকেরা তো নয়ই। শিক্ষকেরা আশা করছেন, সরকার আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের ন্যায্য দাবি মেনে নেবে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি তাঁরা সমর্থন জানালে সরকার সেটি ভালো চোখে দেখবে না। সরকারকে তো তাঁরা বেজার করতে পারেন না।
শিক্ষকদের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা চান না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জিনাত হুদা। তাঁর ভাষ্য, ‘আমাদের আন্দোলনে কোনো শিক্ষার্থী সম্পৃক্ত হোক, এটি আমরা চাইনি। কাউকে জানানোর কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও মনে করি না। এটা পুরোপুরি শিক্ষকদের আন্দোলন, শিক্ষকেরাই এ আন্দোলন করবে। এটার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’(ডেইলি স্টার, ৮ জুলাই ২০২৪)