এখন বেনজীরকে পায় কে!
গণমাধ্যমে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসার পর থেকে তাকে নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। দুর্নীতির জন্য তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। গণমাধ্যমে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ সম্পর্কে বোমা বিস্ফোরণের মতো খবর প্রকাশিত না হলে দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামত কিনা, সে ব্যাপারে দেশবাসীর মনে গভীর সন্দেহের কথা অনেকেই বলেছেন। আইন অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন হলেও ক্ষমতাধর ও তাদের আশপাশে যারা থাকেন, তাদের দুর্নীতি উদ্ঘাটন ও তাদের বিচার প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে দুদক কতটা স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে, তা নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন আছে, তা উপেক্ষা করা যাবে না। তবে কিছুটা হলেও স্বস্তির বিষয়, গণমাধ্যমের সাহসী ভূমিকার ফলে দুদক নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেনি।
বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় ৬২১ বিঘা জমি, ঢাকার গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ৩টি বিও হিসাব এবং ৩০ লাখ ঢাকার সঞ্চয়পত্রের সন্ধান পেয়েছে দুদক। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব সম্পদ জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
দেশব্যাপী সবাই বলছেন, একজন সরকারি চাকুরে হওয়া সত্ত্বেও কী করে বেনজীর বিশাল পরিমাণ সহায়-সম্পদের মালিক হলেন, তা কোনো অঙ্কেই মেলানো সম্ভব নয়। সমগ্র জীবনে চাকরি থেকে বড়জোর দুই-আড়াই কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। তা দিয়ে কি শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়া যায়? কর্মজীবনে তিনি শুদ্ধাচারের পুরস্কার পেয়েছেন। শুদ্ধাচারের নমুনা কি এই? সরকারের যে কমিটি বেনজীরকে শুদ্ধাচারের পুরস্কার প্রদানের সুপারিশ করেছে, তারা কী করে বেনজীরের সততা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন! যতদূর জানি এবং বুঝি, এ ধরনের পুরস্কার ঘোষণার আগে যাকে পুরস্কার দেওয়া হবে, তার সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তথ্য-তালাশ করার একটি রীতি প্রচলিত আছে। বেনজীরের ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো অনুসন্ধান হয়েছিল কি? হয়ে থাকলে তাতে কী জানা গেছে? না হয়ে থাকলে সেজন্য কে বা কারা দায়ী? সে ব্যাপারেও অনুসন্ধান হওয়া উচিত। বেনজীর শুধু শুদ্ধাচারের পুরস্কারই পাননি, তিনি আমাদের দুটি নিরাপত্তা সংস্থা প্রধানের দায়িত্বে বোরিত হয়েছেন। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের আইজি ছিলেন। এর আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনার হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। বিগত কয়েক বছরে যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন, তার প্রতিটিরই অনুষঙ্গ প্রবল ক্ষমতা। নিঃসন্দেহে বেনজীর আহমেদ গত প্রায় এক দশক ধরে প্রবল ক্ষমতা ভোগ করেছেন। ক্ষমতার সঙ্গে যখন বন্দুক যুক্ত হয়, তখন ক্ষমতা হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর! ইংল্যান্ডের লর্ড অ্যাকটন বলেছেন, Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely. বেনজীরের ক্ষেত্রে লর্ড অ্যাকটনের ঐতিহাসিক উক্তিটি সত্য প্রমাণিত হতে চলেছে বোধকরি। তবে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যায়, মহাক্ষমতাধর যদি তিনি না হতেন, তাহলে হয়তো জনমনে তার সম্পর্কে এত সন্দেহ দানা বাঁধত না।
বেনজীর কী করেছেন? ১ জুনের দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘ভয় দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের জমি কিনে নেন বেনজীর।’ এ প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ হলো গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে বেনজীর পরিবার কিনেছে ৫৯৮ বিঘা জমি। আইজিপি ও র্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময় জমি কেনা হয়। এ প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়েছে, ‘বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের প্রায় ৬০০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। এসব জমির প্রায় সবই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। হিন্দ্র সম্প্রদায়ের লোকজন বলেছেন, জমি বিক্রি ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না। ভয় দেখিয়ে, জোর করে এবং নানা কৌশলে তাদের কাছ থেকে জমিগুলো কেনা হয়েছে। গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে গিয়ে জমি বিক্রি করা হিন্দু পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের জমি কিনতে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়োজিত রেখেছিলেন বেনজীর আহমেদ। বেনজীর পরিবারের রিসোর্টের নির্মাণকাজের তদারক করতেন পুলিশ ও র্যাবের কিছু সদস্য। তাদের দিয়ে তরমুজ চাষসহ কৃষিকাজও করানো হয়েছে। মাঠপর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিষয়টি প্রথম আলোর কাছে স্বীকারও করেছেন। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্দেশ দিলে কিছু করার থাকে না। বেনজীর আহমেদ এসব জমি কেনা ও রিসোর্ট গড়ার কাজটি করেছেন আইজিপি (২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সেপ্টেম্বর) ও র্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময় (২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল)।
আমরা জানি, কোনো সরকারি কর্মকর্তা তার ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার বেআইনি নির্দেশ পালন করতে বাধ্য নন। এ ব্যাপারে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক কাজে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ সদস্যদের নিয়োজিত করতে পারেন না। যদি তা করা হয়, সেটা অন্যায় ও অপরাধ।’ বেনজীর নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের তার ব্যক্তিগত কাজের জন্য ব্যবহার করেছেন। এ কাজ গর্হিত অপরাধ এবং নিন্দনীয় বটে। বেনজীরের হয়ে কিছু অধস্তন কর্মকর্তা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে ভয়-ডর দেখিয়ে জমিগুলো বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন, এমন স্বাধীনতা হরণের ঘটনা একটি স্বাধীন দেশে কল্পনা করা যায় না। ক্রেতার পক্ষ থেকে পুলিশি ক্ষমতার জোরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করার ঘটনা ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে চরমভাবে বৈষম্যমূলক। সরকারের মন্ত্রীরা কথায় কথায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন। রাজনীতিতে তারা নিজেকে জাহির করেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরম বন্ধু হিসাবে। এ সরকারের শাসনামলে আমরা যখন দেখি সরকারেরই অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা ছলেবলে-কৌশলে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি হাত করার নিকৃষ্ট প্রয়াসে লিপ্ত, তখন অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা গাল-গল্পের মতোই মনে হয়।