‘মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটি কি ইতিহাস হতে যাচ্ছে?

যুগান্তর ড. আর এম দেবনাথ প্রকাশিত: ১৮ মে ২০২৪, ১১:৫৪

মাছে ভাতে বাঙালি, না ভাতে মাছে বাঙালি-কোনটি সত্য? আসলে সত্য-মিথ্যা প্রশ্ন নয়, আসল কথা হচ্ছে, বাঙালির ভাত ছাড়া চলবে না, আবার তার মাছ ছাড়াও চলবে না। একটির দরকার বাঁচার জন্য, আরেকটির পুষ্টির জন্য। বড় প্রশ্ন এখন-এত উৎপাদন ও আমদানির পরও বাঙালিকে কি মাছের আশা ছাড়তে হবে? মাংস তো দুর্মূল্য হয়েছে। সবজিও তা-ই। কেবল চালটা মোটামুটি ঠিক আছে। মুরগির ডিম, দুধ, শাকসবজি ও তরিতরকারির বাজারের কথা আমরা জানি। সবই সত্য। কিন্তু মহাসত্য এই যে, মাছে ভাতে বাঙালির সুনামটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে দিন দিন। কেন এ কথা বলছি? বলছি সাম্প্রতিক একটা জরিপের তথ্যের কথা জেনে। জরিপটি করেছে সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)। গত ১০ তারিখের একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে-‘খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে, বড় ভূমিকা মাছের দামের’। খবরের মূল কথা হচ্ছে, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। গত এক বছরে মাছের দাম ২০ শতাংশের উপর বেড়েছে। এরপর বেড়েছে মুরগিসহ পোলট্রিপণ্যের দাম। এখানে উল্লেখ্য, গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হচ্ছে বেশি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্ট্যাটিস্টিকসের (বিবিএস) মতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশে সামগ্রিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু একই সময়ে করা বিআইডিএসের গ্রামীণ এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ‘গরিব মানুষের ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৫ শতাংশ। বাড়তি এ মূল্যের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ অসুবিধায় আছেন।’ বিআইডিএসের জরিপ বলছে সারা দেশের কথা। সারা দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে মাছ ও পোলট্রিপণ্যের দাম।


এই খবরের সরলার্থ হচ্ছে, গ্রামে মাছ ও পোলট্রিপণ্যের দাম বেশি শহরের তুলনায়। এই জরিপের সঙ্গে সাধারণভাবে বিশ্বাস করা তথ্যের মিল আছে। যেমন, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ হচ্ছে মাছের জায়গা। সেখানকার লোকের কথা হলো, ওই অঞ্চলে এখন মাছ পাওয়া যায় না। নদী, হাওড় ও বিলে যে মাছ ধরা পড়ে অথবা যে মাছ চাষের, তা রাতে ট্রাকভর্তি হয়ে ঢাকায় চলে আসে। অবশিষ্ট যে মাছ থাকে, তা দিয়ে গ্রামীণ চাহিদা মেটানো যায় না। দাম থাকে চড়া। তাছাড়া এর সঙ্গে যোগ হয় আরেকটি বিষয়। ভালো মাছটা নেয় স্থানীয় প্রশাসনের লোকেরা। এদের সমীহ করে চলতে হয় মাছ ব্যবসায়ী ও জেলেদের। তাদের ‘রোজগার’ আছে। তারা বাজারের সেরা মাছটা নিয়ে নেয়। শুধু মাছ নয়, শাকসবজি, পোলট্রিপণ্যের সেরাটাও নিয়ে নেয় তারা। অবশিষ্ট যা থাকে তা অতি নগণ্য। পাঙাশ, তেলাপিয়া-জাতীয় মাছই গ্রামের মানুষের ভাগ্যে জোটে। রুই, কাতলা, শিং, মাগুর, সরপুঁটি, মৌরলা, কাচকি ইত্যাদি মাছ ধীরে ধীরে গ্রামে হচ্ছে বিরল। এসব কথা গ্রামের লোকরা এখন খোলাখুলিই বলেন। শুধু স্থানীয় প্রশাসনিক লোকজন-কর্মকর্তাই নয়, যোগ হয় ‘রেমিট্যান্স’ প্রাপকরা। যেসব অঞ্চলে প্রবাসী আয় আসে, সেখানে প্রবাসীদের পরিবার ‘রাজা’। তারা বাজারকে করে আরও উত্তপ্ত। ফলে দেখা যাচ্ছে, গ্রামে নীরবে দেখা দিচ্ছে পুষ্টির সমস্যা।


বলছিলাম ভাত ও মাছের কথা। ভাত প্রধান খাবার। ভাত ছাড়া চলবে না। ভাতের একটা ব্যবস্থা হয়েছে। চালের উৎপাদন ভালোই। দামও মোটামুটি সহনশীল। শ্রমজীবীদের মধ্যে যাদের সারা বছর শ্রম দেওয়ার ক্ষমতা আছে, তারা ভাতের অভাবে কষ্ট পায় না। সমস্যা বেকার, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, বৃদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত এবং প্রান্তিক মানুষের। তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকার ন্যায্যমূল্যে সারা দেশে ১ কোটি পরিবারকে চাল-তেল দেয়। শহরে রয়েছে ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) খোলা বাজারি কার্যক্রম। এতেও কিছু চাহিদা মেটে। কিন্তু এসব তো ভাতের কথা, তেলের কথা। মাছের কী হবে? মাংস, ডিম, দুধের কী হবে? এসব তো সরকার বণ্টন করে না। ঈদের আগে মাংসের ব্যবস্থা হয়েছিল, যার গুণগতমান প্রশ্নবিদ্ধ। ভাত হলো কিন্তু মাছ হলো না, তাহলে বাঙালি হয় কীভাবে? আমাদের ভাত দরকার বেঁচে থাকার জন্য। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি দরকার মেধার জন্য। মেধাবী বাঙালি তৈরির জন্য তা দরকার। দেখা যাচ্ছে, এ জায়গাতে আমরা ব্যর্থ হয়ে পড়ছি। আমরা বিগত ৫২-৫৩ বছরে যেমন পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য তৈরি করে ফেলেছি, তেমনি মেধা বিকাশের পথ করে ফেলছি বন্ধ। বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অপুষ্টির খবর আসে। নবজাত শিশুদের অপুষ্টির কথা, মায়েদের অপুষ্টির কথা। শিশুরা হচ্ছে খর্বকায়, ওজন হচ্ছে কম। মেধা থাকছে অবিকশিত। বিশাল এক সমস্যা তৈরি হয়েছে এক্ষেত্রে। গ্রামাঞ্চল বঞ্চিত হচ্ছে পুষ্টি থেকে। মেধা থেকে। বিআইডিএসের সাম্প্রতিক জরিপ এ চিত্রই তুলে ধরেছে। গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি। কী মারাত্মক কথা! গ্রামেই মাছ উৎপাদিত হয়; গ্রামেই দুধ, ডিম, মাংস উৎপাদিত হয়। শাক-সবজি, তরিতরকারি উৎপন্ন হয়। অথচ সেখানেই এসবের দাম বেশি। সেখানেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি। এ খবর আমাদের জন্য ভীষণ উদ্বেগের।


কথা আরও আছে। যেমন ইলিশ মাছ। পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে হলে/হোস্টেলে প্রতিদিন পাতে ইলিশ মাছ দেওয়া হতো। বিতৃষ্ণ হয়ে উঠতাম আমরা। প্রতিবাদ হতো। প্রতিদিন ইলিশ খাওয়ানো চলবে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের দক্ষিণ দিকে দুটি হোটেল ছিল। সেখানে ছুটির সময় আমরা ৬০-৮০ পয়সায় ভাত, ইলিশ একটুকরো, ভাজি ও ডাল খেতে পারতাম। আর আজ? আজ ইলিশ একটা স্বপ্ন আমাদের কাছে। এক কেজি ওজনের একটা ইলিশের দাম পড়ে ১৮০০-২০০০ টাকা। ভাবা যায়! একটা ইলিশে পাঁচজনের সংসারে একবেলা খাবার হবে কি? অসম্ভব। অথচ ইলিশ মাছ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে অগ্রণী দেশ। মোট মাছ উৎপাদনের ১০-১২ শতাংশই ইলিশ বলে আমাদের জানানো হয়। অথচ ইলিশ পাতে ওঠার জোগাড় নেই। শুধু ইলিশ বলছি কেন, কোন মাছটা পাতে উঠবে এখন? শাক-সবজির দাম তো ধীরে ধীরে কেজিপ্রতি ৮০-১০০ টাকা হয়েছে। কাঁচা পেঁপে, ঢেঁড়স, পাটশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক, ডাঁটা ইত্যাদি যেসব সবজি মানুষ একসময় কম কিনত, সেগুলোর দামও আকাশচুম্বী। এই প্রেক্ষাপটে মাছ হয়ে উঠছে দুর্মূল্য। সামান্য একটু বড় সাইজের পুঁটিমাছের কেজি ৭০০-৮০০ টাকা। শিং, মাগুর, কৈ ধরার কোনো উপায় নেই। দেশি কৈ মাছের যেন সোনার দাম। যে কাতলা, রুই সস্তায় পাওয়া যেত, তাদের দামও এখন চড়া। মৌরলা, কাচকি ইত্যাদি মাছের কেজিপ্রতি দাম কত? এসব খবর কাগজে ছাপা হচ্ছে প্রতিদিন। মাছের বাজারের ‘আগুন’ নিয়ে প্রতিদিন খবর হচ্ছে। মানুষের কষ্টের কোনো সীমা নেই। মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত লোকের পক্ষেও মাছ খাওয়া এখন ধীরে ধীরে বিলাসিতায় পরিণত হচ্ছে। মানুষ মাছের দামের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। সব জিনিস উচ্চমূল্যে কেনার পর হাতে আর টাকা থাকে না মাছ, মাংস, দুধ, ডিম খাওয়ার। মুশকিল হচ্ছে, এ মূল্যবৃদ্ধির কোনো সীমারেখা পাওয়া যাচ্ছে না। ডিম, দুধ, মাংসের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাছের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শোনা যায় আজকালকার শিশুরা, তরুণরা মাছ খেতে চায় না। তাহলে তো চাহিদা কম থাকার কথা। দামও কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাজারে তো এর কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও