বাঙালি চুপ করে থাকে চাকরির ভয়ে
চুপ করে আছে বলেই যে চুপ আছে– জাপানিদের সম্পর্কে এটা মনে না-করার প্রবণতা বেশ ব্যাপ্ত। এ নিয়েও গল্প রয়েছে। ধরা যাক একটা হাতি এসেছে। সেখানে যদি একজন ইংরেজ থাকে তাহলে সে ভাববে, হাতিটি নিশ্চয় আমাদের উপনিবেশগুলোর কোনো একটি থেকে এসেছে। জার্মান ভাববে, আমাদের দেশে হাতি নেই। কিন্তু থাকলে সেটাই হতো পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হাতি। আমেরিকান ভাববে, বেশ তো দেখতে; এটি আমি কিনে নেব। ফরাসির চিন্তা হবে, কত সুস্বাদু খাবার না জানি এর মাংস দিয়ে তৈরি করা যায়! আর জাপানি ভাববে, হাতিটি কী ভাবতে পারে? চুপচাপ থেকে জাপানিরা কেবল মতলব ঠিক করে যে, তা নয়। অন্যে কী মতলব ফাঁদছে, সেটাও সে উদ্ধার করতে চায়। এ জন্যই জাপানিদের নিশ্চুপতা এত গভীর।
গল্পে বাঙালির উল্লেখ নেই। বাঙালিকে নিয়ে কে-ইবা ভাবে! সে নিজেই ভাবে না। কিন্তু ধরা যাক, হাতিটিকে একজন বাঙালিও দেখল। তার প্রথম ভাবনা হবে, চাপা দেবে না তো! সেই ভয় কাটিয়ে উঠলে ভাবতে পারে, হাতিটির মালিকের না জানি কত টাকা! আচ্ছা, সে কি আমাকে একটা চাকরি দিতে পারে না? হাতিটির যত্ন-আত্তির জন্যও তো অনেক লোক দরকার।
হাতির সামনে বাঙালিও চুপ থাকবে ঠিকই, কিন্তু জাপানির মতো ভাববে না– হাতি কী ভাবছে। তাকে সে ভয় পাবে। আবার কিছু পাওয়ার আশায়ও থাকবে। তবে শুধুই ভাববে; প্রকাশ করবে না ভাবনা। অন্যকে বলবে না। পার্শ্ববর্তী বাঙালিকে তো নয়ই। পাছে সে সম্ভাব্য চাকরিটা হাতিয়ে নেয়। বাঙালি মাত্রই বাঙালির প্রতিদ্বন্দ্বী। ভয়ের কথা তো অন্য মানুষকে বলবেই না। যত পারে বাহাদুরি ফলাবে।
সব বৈশিষ্ট্যের পেছনেই বাস্তবিক কারণ থাকে; জাতিগত বৈশিষ্ট্যের পেছনেও বটে। ঐতিহাসিক সব কারণ। কত যুগ আমরা বিদেশি শাসনের অধীনে ছিলাম। তারা ছিল ওই হাতির মতোই। যত দূরে থাকে ততই মঙ্গল, কাছে এলে ভয়ংকর বিপদ। পায়ের তলে পিষে ফেলবে। পিষে ফেলেছেও। আর্য, মোগল, পাঠান, ইংরেজ, পাঞ্জাব– সবারই ওই এক কাজ। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি পুলিশ এখনও যদি গ্রামে আসে, তবে গ্রামবাসী উৎফুল্ল হয় না, পালাবার কথাই ভাবে। গরিবের ঘরে হাতির পা– এই প্রবচন এমনি এমনি তৈরি হয়নি।
আর চাকরি? সেটাই তো প্রধান জীবিকা আমাদের। কৃষকের কথা আলাদা। সে পড়ে থাকে মাটি আঁকড়ে, যতক্ষণ পারে। মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তার সর্বনাশ হয়ে যায়। কোথায় যে ভেসে যায় চলে, কোনো হদিস থাকে না। কৃষক হাতি দেখে না, কোনো কিছু আশাও করে না। কিন্তু যারা কৃষক নয়, উঠে এসেছে ভূমি ছেড়ে, তারা আর কী করবে চাকরি-বাকরি ছাড়া?
ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙালির উৎসাহ নেই– এ কথা বৈজ্ঞানিক প্রফুল্লচন্দ্র রায় অবিরাম বলেছেন। কথাটা সত্য বটে, তবে আংশিক। বাকি অংশ হলো এই যে, বাঙালির সামনে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ খোলা ছিল না। তাঁর হাতে পুঁজি ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্য যা করবার তা জগৎ শেঠরা, ইংরেজরা, মাড়োয়ারিরা, দিল্লিওয়ালারা আরামসে করেছে। বাঙালি পারেনি। বাঙালির জন্য মোক্ষলাভের পথ ছিল ওই একটিই– চাকরি। পথটা মোটেই প্রশস্ত ছিল না। বিস্তর ঠেলা-ধাক্কা ছিল সেখানে। এখনও আছে। এখন বরঞ্চ আরও বেশি। লাখ লাখ বাঙালি আজ পরিপূর্ণ কিংবা অর্ধবেকার। হাতির লেজ থেকে মাছি তাড়াতে হবে– এই পদের জন্য বিজ্ঞাপন দিক না কোনো হাতিওয়ালা; দেখা যাবে কত হাজার দরখাস্ত পড়ছে এই সোনার বাংলায়।
ওই ভয়, এই আশা– এটা বড় মর্মান্তিক সত্য বাঙালির জন্য। পরাধীনতা এই দেশে পুঁজির বিকাশে সাহায্য করেনি, কৃষি থেকে যে উদ্বৃত্ত এসেছে, তা পাচার হয়ে গেছে কিছুটা; বাকিটা চলে গেছে ভোগবিলাসে। পুনরুৎপাদন কিংবা শিল্পায়নে নিয়োজিত হয়নি। ফলে পরমুখাপেক্ষিতা বড়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনও আমরা ভাবি, পুঁজি আসবে বিদেশ থেকে। সাহায্য, ঋণ– এসব বিদেশিরাই দেবে। আত্মনির্ভরশীল জাতি আমরা কবে হবো কে জানে! বারবার স্বাধীন হলাম, কিন্তু আত্মনির্ভরশীল হওয়া হলো না। বরঞ্চ পরনির্ভরতা বাড়ছে তো বাড়ছেই, যেন অন্তহীন। বিদেশিরা চাকরি দিলে আত্মহারা হয়ে পড়ি; পিঠ চাপড়ে দিলে তো কথাই নেই।
অত্যন্ত গভীরে চলে গেছে আমাদের পরগাছাবৃত্তি। সর্বস্তরেই। পরগাছারা কখনোই স্বাধীন নয়। আশ্রয় চলে গেলে তাদের আর কিছুই থাকে না; সে জন্য প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে রাখে সে আশ্রয়কে। আত্মসমর্পণ বেশি বলেই জীবনযাত্রার মান ওঠে না– আমাদের সম্পর্কে এটা যারা বলেন, তারা মিথ্যা বলেন না। মুখ দিয়েছেন যিনি, আহারও দেবেন তিনি– এই যে আত্মসমর্পণ তথা পরনির্ভরতা, সেটাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটা প্রধান কারণ বললে অত্যুক্তি হবে কি? উন্নত জীবনের আশা কিংবা আকাঙ্ক্ষা কোনোটাই এ মাটিতে আগুন জ্বালায় না; চোখের দৃশ্য-অদৃশ্য জল-মাটিকে কাদাতে পরিণত করে। তাল তাল কাদা দেখা যায় চতুর্দিকে। আমরা রীতিমতো কর্দমাক্ত।