
ইন্টারনেটে শিশুর ছবি শেয়ারে সাবধান
কয়েক বছর আগে আমাদের দেশের একজন বিখ্যাত তারকা তাঁর শিশুকন্যার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছিলেন। তিনি হয়তো সরল মনে, নিজের আনন্দটুকু অন্যের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য ছবিটি পোস্ট করেছেন। কিন্তু তারপর শুরু হয় কুরুচিপূর্ণ, আপত্তিকর বাজে মন্তব্য এবং নানা তর্ক-বিতর্ক। ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে এত বেশি মাতামাতি ও বিতর্ক হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত এই উত্তাপ পত্রিকার পাতায় গিয়ে গড়িয়েছে।
আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, সেলিব্রেটিরা তাঁদের শিশুর ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। এই ঘটনাগুলো শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই ঘটছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তারপরও আমরা সচেতন হই না। প্রায়ই শিশুদের স্পর্শকাতর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দিই। শিশু জন্মের পর থেকে প্রতিনিয়ত আমরা এ ধরনের ভুল করছি।
পরিবারে নতুন শিশুর আগমন, নিঃসন্দেহে আনন্দের বিষয়। মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পরিবারের মানুষজন ছবি তোলা, শিশুকে নিয়ে মাতামাতি, আনন্দ-ফুর্তি-উৎসব, সোশ্যাল মিডিয়ায় নবজাতকের ছবি শেয়ার করা ইত্যাদি আরও অনেক কিছু করছেন।
প্রিয়জনেরা জন্মের পর নবজাতকের ছবি তোলেন সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার জন্য। কিন্তু আপনি কি জানেন এর মাধ্যমে শিশুর কী ধরনের সর্বনাশ করছেন? ছবি তোলার সময় ব্যবহৃত ফ্ল্যাশের আলোয় নবজাতকের চোখ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আসলে নবজাতকের নাজুক চোখ এখনো তীব্র আলো সহ্য করার মতো অবস্থায় যায়নি। এ ক্ষেত্রে আপনার সামান্য ভুল শিশুকে ভোগাতে পারে সারা জীবন।
আপনি হয়তো অন্যকে জানানো অথবা শুধু লাইক পাওয়ার আশায় সোশ্যাল মিডিয়ায় শিশুর ছবি পোস্ট দিচ্ছেন। অথবা শিশুর প্রতিটি স্মরণীয় ঘটনার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার মাধ্যমে আনন্দটুকু সবার সঙ্গে শেয়ার করতে চাইছেন। শিশুদের ছবি বা ভিডিও এভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করাকে বলে ‘শেয়ারেন্টিং’ (Sharenting)। কিন্তু আমরা কি জানি, এভাবে ছবি শেয়ার করার ফলে ভবিষ্যতে শিশুর জীবন কতটা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে, এর নেতিবাচক পরিণতি বা প্রতিক্রিয়ার রেশ কতটা ভয়ংকর হতে পারে? হয়তোবা এই ছবির নেতিবাচক রেশ শিশুকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হতে পারে।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ইন্টারনেটে শেয়ার করা কোনো ছবিই হারিয়ে যায় না, ডেটাবেইসে থেকে যায়। এমনকি ছবি পোস্ট দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে ডিলিট করে দিলেও। যখনই শিশুর কোনো ছবি ইন্টারনেটে পোস্ট দিলেন, সেটি আর ব্যক্তিগত বা প্রাইভেট রইল না, মুহূর্তেই পাবলিক হয়ে গেল। পরে এই ছবিগুলো যে যার মতো করে দেখতে পারবে, ব্যবহার করতে পারবে।
প্রতিনিয়ত ছবি শেয়ার করার ফলে অনলাইন জগতে শিশুর ডিজিটাল ফুট প্রিন্ট তৈরি হয়ে যায়। প্রতিনিয়ত সার্চ টুলগুলো উন্নত ও শক্তশালী হচ্ছে। ভবিষ্যতে আপনার শিশুর নাম, জন্মতারিখ, জিওট্যাগ লোকেশন এবং ফেসিয়াল রিকগনিশনের মাধ্যমে যে কেউই এসব ছবি দেখার সুযোগ পাবে। আপনার অজান্তেই শিশুদের এসব ছবি পণ্যের বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার করা হতে পারে।
আশঙ্কা এখানে নয়। ভবিষ্যতে এসব ছবি কীভাবে ব্যবহার হবে, এটাই মূল আতঙ্ক। আসলে সোশ্যাল মিডিয়ার পরতে পরতে ওত পেতে আছে বিপদ। আপনার একটু অসতর্কতা বা হেঁয়ালিপনা ধ্বংস করে দিতে পারে শিশুর ভবিষ্যৎ। লাগামহীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার ও ডিফফেক প্রযুক্তি এখন একটি মূর্তিমান আতঙ্ক। আপনার শিশুও এর শিকার হতে পারে। ভবিষ্যতে এই শিশু যদি বিখ্যাত বা সেলিব্রেটি কেউ হয়, তখন এই ছবির জন্য সে বিব্রত কিংবা অসম্মানিতও হতে পারে।
মা-বাবা না বুঝেই শিশুর স্পর্শকাতর ছবি পোস্ট দেন; বিশেষ করে শিশুর বস্ত্রহীন ছবি সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। তাই শিশু যত ছোটই হোক, শিশুর পোশাকহীন ছবি অথবা পোশাক পরিবর্তন করার ছবি ইন্টারনেটে শেয়ার করবেন না। গোসল করানোর মুহূর্ত বা খালি গায়ে ঘোরাঘুরির ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবেন না। শিশুকে বুকের দুধ পানের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেবেন না। এ ধরনের ছবির জন্য ভবিষ্যতে আপনি ও আপনার শিশু দুজনই বিড়ম্বনার শিকার হতে পারেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ইন্টারনেট ব্যবহার
- ছবি শেয়ার