ফেল করা সন্তানকে স্পর্শ করুন, বুকে জড়িয়ে ধরুন
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। পাসের শতকরা ৮৩.০৪ ভাগ। অর্থাৎ ১৬.৯৬ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। কেবল তা–ই নয়, প্রথম আলোর খবরে প্রকাশ, দেশের ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি।
যারা ফেল করেছে, তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে জীবন কত কঠিন। পাস-ফেল কী বিষয়। কী কালো মেঘ তাদের ওপর ভর করছে। অনুভব করছে ফেল করা মানেই প্রত্যাখ্যাত হওয়া। আর প্রত্যাখ্যান মানেই দীর্ঘ বিস্বাদ-হতাশা। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া–প্রতিবেশী কারও কাছেই আজ তারা সম্মানিত তা আদরণীয় নয়। কারণ, এ সমাজ সফলদের বরণ করে, ব্যর্থদের নয়।
২০০৯ সাল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী পরিচালিত গণসাক্ষরতা অভিযানে কাজ করি এবং এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই।
গণসাক্ষরতা অভিযান ২০০৯ সালে জুলাই মাসে এসএসসি পরীক্ষায় ফেল শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকায় একটি সম্মেলন করে। এ সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল—শিক্ষার্থীদের ফেল করার কারণ ও উত্তরণের উপায় অনুসন্ধান। প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীদের ফেল করার পেছনে প্রায় ২০-২৫টি কারণ চিহ্নিত করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমূল হক সম্মেলনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করে মন্তব্য করেন, পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর ফেল করার পেছনে রয়েছে চতুর্মুখী কারণ। এই চতুর্মুখী কারণ হলো স্কুলের পক্ষ থেকে অবহেলা, শিক্ষকের অদক্ষতা, অভিভাবকের অসচেতনতা এবং শিক্ষার্থীর সক্ষমতার অভাব।
অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ফেল করার পেছনে তাদের দায় ২৫ ভাগ আর শিক্ষা সুশাসনের দায় ৭৫ ভাগ। শিক্ষার কাঠামোগত ব্যর্থতার দায় পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। এসব শিক্ষার্থী সাধারণত প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত এবং নানা রকমের প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে জীবন বয়ে নেয়। তবে এসব প্রতিকূলতার ভেতর থেকেও কেউ কেউ যে বেরিয়ে আসছে, না তা নয়। এদের আমরা অদম্য হিসেবে চিনি।
ফেল করার পেছনে যেমন বড় কারণ থাকে, তেমনি থাকে ছোট কারণ। যেমন সেই সম্মেলনে কিছু শিক্ষার্থী বলেছিল, পরীক্ষার আগে আগে তারা বাবা-মাকে হারিয়েছে। ফলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। দু-একজন বলেছিল, তাদের মা-বাবার মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। কয়েকজন কন্যাশিক্ষার্থী জানিয়েছিল, দশম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকে তাদের ওপর বিয়ের চাপ ছিল। এ মানসিক চাপ নিয়ে তারা স্থিরভাবে পড়াশোনা করতে পারেনি। ফেল করা শিক্ষার্থীদের বর্ণনা এত মর্মস্পর্শী ছিল যে মঞ্চে উপস্থিত অতিথিদেরসহ অনেকের চোখে পানি ধরে রাখা সহজ ছিল না।
মানুষ মূলত সফলদের গল্প শুনতে অভ্যস্ত। ব্যর্থদের গল্পে থাকে কম আসক্তি। কিন্তু তথাকথিত এসব ফেল করা শিক্ষার্থীর গল্প অনেকের কাছে ছিল আলোকবর্তিকাস্বরূপ। কারণ, অ্যালেক্স হেলি তার ‘রুটস’ উপন্যাসে বলেছেন, যথাযথভাবে নির্মিত হলে কেবল বিজয়ী নয়, বিজিতদের ইতিহাসও মহত্তর হতে বাধ্য। সত্যি আমরা যদি ফেল করা শিক্ষার্থীদের কথা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনি, তবে তাদের মধ্যে তৈরি হবে দায়বদ্ধতা।