মার্চের আগের কয়েকটি বিষয় নিয়ে কথা
১৯৭১ সালের মার্চ মাসটা ছিল এক অনন্য মাস। এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত যেন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সাতই মার্চের ভাষণ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। কিন্তু সেই সময়ের প্রেক্ষাপটটি নিয়ে বিশ্লেষণ হওয়া জরুরি।
ছয় দফাকে আওয়ামী লীগ বলেছিল বাঙালির মুক্তিসনদ। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছয় দফা নিয়ে ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া; বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো আর পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাপের মওলানা ভাসানী ছয় দফার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। আইয়ুব খানের মন্ত্রীরা লাগাতারভাবে ছয় দফার বিরোধিতা করেছেন, স্বয়ং আইয়ুব খানও ছয় দফার জবাব দিতে চেয়েছেন অস্ত্রের ভাষায়।
উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জেলখানা থেকে মুক্ত করে আনল, তখনই জনগণ নিশ্চিত ছিল সেই মুহূর্তে পাকিস্তানের ইতিহাসের মূল নায়ক কে। আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানকে চিনতে ভুল করেননি। তাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে চিরতরে রাজনীতি থেকে অপসারিত করতে চেয়েছিলেন। ফল ফলেছিল উল্টো।আইয়ুব খানের ডিকেডি আমলেরই তাতে অবসান হলো। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে নির্বাচনের কথা ঘোষণা করলেন।
ইতিহাসকে সঙ্গী করলে আমরা এই সময়টাকে খুবই পরিষ্কারভাবে দেখতে পাব। শেখ মুজিবুর রহমান তখন পূর্ব বাংলায় জনপ্রিয়। তাঁর জনপ্রিয়তার পাশে অন্য নেতাদের রাজনীতি হয়ে উঠেছিল কঠিন। সে অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিকে বাধা দিতে নানামুখী চেষ্টা চলেছে। ন্যাপসহ বেশ কয়েকটি দলের ছয় দফা বিরোধিতার পাশাপাশি আরও একটা বিষয় ক্রিয়াশীল ছিল। সেটা হলো, শেখ মুজিবুর রহমান যেন ম্যান্ডেট পেয়ে না যান। সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ মুজিব যদি তাঁর দল আওয়ামী লীগকে নিয়ে জয়ী হন, তাহলে ছয় দফাই হয়ে উঠবে জাগরণের বাণী। শেখ মুজিব হয়ে উঠবেন অবিসংবাদিত নেতা।
তাই নির্বাচন নিয়ে টালবাহানার সৃষ্টি হয়। এই সময় আমরা দেখতে পাই ন্যাপের মওলানা ভাসানীর অস্থিরতা। অনেকেই মওলানার রাজনীতির নানা সফলতার আলোচনা করেন বটে, কিন্তু কোনো কোনো সময়ে তাঁর রহস্যময় আচরণের কথা ভুলে যান। ১৯৭০ সালের নির্বাচন যেন না হয়, সে জন্য কত কিছুই না করেছেন মওলানা ভাসানী। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে ছাত্রলীগের বামপন্থী ধারাটির কথাও কিঞ্চিৎ আলোচনা হওয়া দরকার।
১৯৬৯ সালে যখন শেখ মুজিব জেলখানা থেকে বের হলেন, তখন দেখা গেল, ছাত্রলীগের একটা বড় অংশ তত দিনে বাম দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ছাত্রলীগের এই অংশটির নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল বিমুগ্ধ হওয়ার মতো। সাংগঠনিক সভায় তাঁর বক্তৃতা দারুণভাবে আকৃষ্ট করত তরুণ প্রজন্মকে। তিনি প্রকাশ্য জনসভায় খুব একটা অংশ নিতেন না।
কিন্তু তাঁর তীক্ষ্ণধার প্রচারণার দিকে তরুণেরা আকৃষ্ট হতো অন্ধের মতো। পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা দেখেছি, ছাত্রলীগের ভাঙনের পর মেধাবী ছাত্রদের একটি বড় অংশ সিরাজুল আলম খানের প্রতি আস্থা রেখেছিল এবং তারাই আরও কিছুদিন পর জাসদ তৈরি করেছিল। সে আরেক ইতিহাস।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ৭ মার্চের ভাষণ
- অগ্নিঝরা মার্চ