কিছু পুরোনো কথা, তারপরও বলাটা জরুরি
গজদন্ত মিনারে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের কাছে এখনো বাংলা ছোটলোকের ভাষা। একটু কান পাতলেই শোনা যাবে, নিজেদের ভেতর বাতচিতকালে তাঁরা বাংলায় নয়, শব্দ ভাঁজেন ইংরেজিতেই। শিক্ষার মাধ্যমে, অনুষ্ঠানের শিরোনামে, রাস্তাঘাটে দোকানপাটের নামকরণে যেভাবে বাংলা অবহেলিত হচ্ছে, তাতে মনেই হয় না বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা।
ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষ নেই, কিন্তু বাংলার প্রতি অবজ্ঞা, কী আশ্চর্য, সমাজের উঁচু শ্রেণি ও ক্ষমতাধরদের চোখেই পড়ছে না। অথচ দেখুন প্রতিদিন আমরা কত আক্ষেপ করি আমাদের আগের মতো ভালো বাংলা সাহিত্য নেই, ভালো বাংলা চলচ্চিত্র নেই! এটা অনেকটা নিজের চোখে কড়িকাঠ রেখে, অন্যের চোখের কুটো নিয়ে সমালোচনা করার মতোই। বাংলাকে যথাযথ মর্যাদা দিন, ভালো সাহিত্যকর্ম ও চলচ্চিত্র হবে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে দেশের একটি শ্রেণি যে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল অপরাধ করছে, সেই বোধের ঘণ্টি কে পরিয়ে দেবে তাদের গলায়? প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আমরা শিক্ষিত করছি ইংরেজিতে, অথচ ফল চাইছি বাংলা ভাষায়। এ যেন বটবৃক্ষের কাছে আম্রপালি প্রত্যাশা! যেন মঙ্গল গ্রহ থেকে কেউ এসে ভূমিসংলগ্ন শিল্প সৃজন করে দিয়ে যাবে! নিজের দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা যদি মাতৃভাষা ভালো করে আয়ত্ত না করে, যদি ভাষার প্রয়োগ ঠিকঠাক না শেখে, তাহলে সেই ভাষায় সে সৃষ্টি করবে কেমন করে?
যারা ইংরেজি মাধ্যমে না ঘরকা, না ঘাটকা শিক্ষা অর্জন করছে, তারা না শিখছে দেশের ভাষা, না শিখছে ইতিহাস ও সংস্কৃতি। বাইরের দেশের পাঠ্যক্রমে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি কোথায়? বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে আবির্ভূত হয়েছে ইংরেজি ভাষায় দেশি পাঠ্যক্রম।এই ইংরেজি কি ব্রিটিশ, না উত্তর আমেরিকার, তার হিসাব কে রাখে? শুনেছি দেশীয় পাঠ্যক্রমের ইংরেজি বই নাকি এখন ধর-তক্তা-মার-পেরেক কায়দায় গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনুবাদ-দক্ষতার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিপর্যয় রুখবে কে?
বাংলার জলবায়ুর ভেতর থেকে, কেউ যখন ইংরেজি আত্মস্থ করার চেষ্টায় রত থাকে, তখন তার অচেতনের গঠনেও সেটার প্রভাব পড়ে। বাংলা ও ইংরেজির গঠন এক রকম নয়। দেখবেন যারা ইংরেজিতে সড়গড়, তারা ইংরেজির কাঠামো মেনে বাংলা বলার চেষ্টা করে। এতে বাংলা হয়ে পড়ে বিকৃত। এর উল্টোটাও হয়। এখন অচেতনের গঠন যদি ভাষার মতো হয়, তবে আমরা গত কয়েক প্রজন্মের অচেতন এমন করে তৈরি করেছি, যা ইংরেজির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। মজার বিষয়, ইংরেজি আমাদের সমাজে এসেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের আধিপত্যকামী শাসনব্যবস্থার হাত ধরে। এখন মগজে ঔপনিবেশিকদের ভাষার গঠন নিয়ে, নিজ দেশের ভাষায় শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নির্মাণ কি সম্ভব?