বাংলাদেশ-রাশিয়া বন্ধু চিরদিনের
জীবনে চলার পথে যার সঙ্গে মনের মিল থাকে, সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে সবকিছু শেয়ার করা যায়, সে-ই বন্ধু। বন্ধুত্ব হলো এমন এক বন্ধন, যেখানে দুজন ব্যক্তি একে অপরকে বোঝে। আপদে-বিপদে, সুখে-দুঃখে সব সময় কাছে থাকে। এক বন্ধু যদি কোনো বিপদে পড়ে, কোনো কিছু বলার আগেই যদি অপর বন্ধু এগিয়ে আসে তাহলে বুঝতে হবে সে প্রকৃত বন্ধু। একজন প্রকৃত বন্ধু সামান্য ঠুনকো অজুহাতে কোনো কথার ছলে বা সামান্য স্বার্থের জন্য বন্ধন নষ্ট করে না; বরং নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়েও বন্ধুর স্বার্থ রক্ষা করে।
একটি কথা প্রচলিত আছে—যে ব্যক্তির জীবনে কম করে হলেও দুজন প্রকৃত বন্ধু আছে, তিনি আসলেই সুখী মানুষ। বন্ধুত্ব স্থাপিত হয় বিশ্বাসের মাধ্যমে। যদি একে অপরের প্রতি বিশ্বাস বা আস্থা থাকে, তাহলে এই বন্ধুত্ব স্থায়ী হয়। চিরদিনের এ রকম বন্ধুত্ব যেমন ব্যক্তিজীবনে আছে, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এ রকম সুসম্পর্কের বন্ধুত্ব দেখা যায়।
২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ-রাশিয়ার মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫২তম বছর। বাংলাদেশ ও বর্তমান রাশিয়ার (তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন) মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মার খেয়ে যাচ্ছে, পরাজয়ের দ্বার প্রান্তে, তখন আমেরিকার সরকার ঘোষণা করল পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য সপ্তম নৌবহর পাঠাবে। আমাদের দেশের মুক্তিকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও সাহস ভেঙে দেওয়ার জন্য এই ঘোষণা যথেষ্ট ছিল। সেই অন্তিম সময়ে রাশিয়া, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে অষ্টম নৌবহর পাঠানোর ঘোষণা দেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের মিত্ররা থমকে গিয়েছিল। অবশেষে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম লাভ করে। সেই সময় বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত ছিল—সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের শক্তি ও মুক্তিকামী শোষিত-বঞ্চিত মানুষের পক্ষের শক্তি, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত বলয়ের দেশগুলো।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল দেশ স্বাধীন করার জন্য, শোষণের হাত থেকে মানুষের মুক্তির জন্য। বঙ্গবন্ধু সেই সময় সোভিয়েত বলয়ের দিকে হাত প্রসারিত করেছিলেন। এই বলয়ের শক্তি বঙ্গবন্ধুকে নিরাশ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় একমাত্র সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম অচল ছিল। পুরো সমুদ্রবন্দরের আশপাশে মাইন পোঁতা ছিল, ডুবন্ত ছিল কয়েক ডজন জাহাজ। কোনো বিদেশি জাহাজ ওই বন্দরে ভিড়তে পারত না। সদ্য স্বাধীন দেশ আমাদের, একমাত্র সমুদ্রবন্দর অচল থাকার কারণে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ ছিল। বহির্বিশ্বের সঙ্গে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য চলার উপক্রম ছিল না। আমাদের কোষাগার ছিল বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল অতিসামান্য। তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বহু দেশের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য। সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে কোনো রকম পারিশ্রমিক ছাড়া আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল করে দিয়েছিল। ১৯৭২ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ১৩ মাস পরিশ্রমের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর সম্পূর্ণ ব্যবহার উপযোগী হয়েছিল।
তখন এই বন্দরকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য যে কমান্ডার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁর নাম পাভেল যুয়েনকো। এই অ্যাডমিরাল বহু বছর সোভিয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে অনেকবার বলেছেন, জীবনের তরে একবার হলেও চট্টগ্রাম বন্দর দেখে যেতে চান। আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম অন্তত দুজন মান্যবর রাষ্ট্রদূতের কাছে অ্যাডমিরাল সাহেব তাঁর মনের এই আশা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু কোনো রাষ্ট্রদূত অ্যাডমিরাল সাহেবের মনের আশা পূরণ করেননি। পাভেল যুয়েনকো বলতেন, ‘আমরা তোমাদের দেশ দখল করতে যাইনি, আমরা তোমাদের দেশের পতেঙ্গার দুই মিটার জায়গা দখল করেছিলাম, আমাদের এক ২২ বছরের তরুণ সদস্য সেখানে শায়িত আছেন, তাঁর কবরের জায়গার জন্য।’ এ কথা বলে বারবার আপ্লুত হয়েছেন।