
রাজনীতির অস্থায়ী ও স্থায়ী দখলদার
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরীর একটি বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও কৌতূহল জাগিয়েছে। দলের মধ্যে তৈরি করেছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তিনি দলীয় এক সমাবেশে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলেছেন, বিএনপি দখল করছে লঞ্চঘাট-বাসস্ট্যান্ড আর জামায়াত দখল করছে বিশ্ববিদ্যালয়। এই কথাগুলো আপাতদৃষ্টিতে মজা বা রসিকতা মনে হলেও আসলে এর ভেতরে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গভীর অসুস্থ চিত্র। মুখে কেউ স্বীকার না করলেও ‘দখল’ বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বলা হয়ে থাকে, এখানে দুই ধরনের ‘দখল রাজনীতি’ চলছে। একদিকে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতিতে ক্ষমতা, অর্থনীতি ও স্থানীয় আধিপত্যের জায়গা নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দিয়েছে, অন্যদিকে জামায়াত ধীরে ধীরে দখল করেছে শিক্ষাঙ্গন, প্রশাসনিক কাঠামো এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়। এ দুই ধরনের দখল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভবিষ্যতের ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলছে।
বিএনপির যে অবস্থান তৈরি হয়েছে, তা অনেকাংশেই প্রতিফলিত করে দলে সংগঠনগত দুর্বলতা ও নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেছিলেন একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর অস্থির সময়টাতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে জন্ম নেওয়া এই দলটি শুরু থেকেই প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক শক্তিনির্ভর রাজনৈতিক সংগঠন ছিল। তাই বিএনপির মধ্যে মাঠপর্যায়ের সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তোলার সংস্কৃতি কখনোই গভীর হয়নি। যখন তারা ক্ষমতায় গেছে, তখনো স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ মূলত ক্ষমতা ব্যবহার করে জমি-বাড়ি দখল, ঘাট-বাজার নিয়ন্ত্রণ, কন্ট্রাক্ট আর চাঁদাবাজির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছেন। এই প্রক্রিয়া এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে দলীয় রাজনীতি এখানে ‘সেবা’ নয় বরং ‘দখল ও ভাগাভাগির’ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে। তারা ধীরে ধীরে সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করতে থাকে। জামায়াতের কৌশল ছিল দীর্ঘমেয়াদি—প্রথমেই তারা শক্তি ঢেলে দেয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাব বিস্তারে। শিক্ষক নিয়োগ, সিন্ডিকেট নির্বাচন, হল-হোস্টেল দখল এবং ইসলামি আদর্শের প্রচারের মাধ্যমে তারা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। শুধু তা-ই নয়, তারা আইনি কাঠামোর ভেতরেও জায়গা করে নেয়, যেমন আদালত, প্রশাসন, শিক্ষাব্যবস্থায় নিজেদের অনুসারীদের বসিয়ে দিয়ে। এভাবে জামায়াতের দখল ছিল ‘মস্তিষ্কের জায়গা’, যেখানে নীতি, সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা তৈরি হয়। এই দখলপদ্ধতি অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর।
আলতাফ হোসেন চৌধুরীর বক্তব্যে এই দুই ধরনের দখলের পার্থক্য স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। বিএনপি যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে আটকে আছে তা হলো শর্টকাট, তাৎক্ষণিক এবং ভোগবাদী মনোভাব। একজন স্থানীয় নেতা যদি বাসস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করে তবে তিনি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবেন, কিছু অনুসারীকে খাওয়াতে পারবেন এবং নির্বাচনের সময় ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারবেন। কিন্তু এই কৌশল স্থায়ী কোনো সাংগঠনিক শক্তি তৈরি করে না। অন্যদিকে জামায়াতের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ মানে হলো তারা আগামী প্রজন্মের শিক্ষক, প্রশাসক, বিচারক এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নিজেদের মতাদর্শ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ফলে জামায়াত ক্ষমতায় না থেকেও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রতিফলন। ক্ষমতার বাইরে ১৭ বছর কাটানোর পরও বিএনপি এখনো একটি শক্তিশালী গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ।
বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও তারা একে সংগঠিত শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারেনি। ২০২২-২৩ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে বিএনপি দেশব্যাপী লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামাতে পেরেছিল, কিন্তু সেগুলো ছিল খণ্ডিত, কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বহীন এবং তৃণমূলভিত্তিক স্থায়ী শক্তিতে রূপান্তরহীন। অথচ একই সময়ে জামায়াত কম দৃশ্যমান হলেও সাংগঠনিকভাবে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রভাব বজায় রেখেছে।