নতুন সরকারের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়
কথাটা আসলে দশ কথার এক কথা। নতুন সরকারের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কোন পথ কুসুমাস্তীর্ণ? মানুষের জীবন চলার পথ, তা সে ব্যক্তিগত জীবন হোক কিংবা হোক সামাজিক বা রাজনৈতিক জীবন? এমন কোনো পথ কি আছে, যেখানে শুধুই ফুল বিছানো থাকে? কাঁটা থাকে না? তাহলে কোনো সরকারের পথই-বা কুসুমাস্তীর্ণ হবে কেন! সরকারকে তো একটা রাষ্ট্র সামলানোর জন্য যাবতীয় কাজ করতে হয়। নিশ্চয়ই তাতে অনেক বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ থাকে। সেগুলো মোকাবিলা করেই তো সরকার পথ চলে। নতুন সরকারও নিশ্চয় তাই করবে।
সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই পথের কথাটা তুলেছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছিলেন, এই নির্বাচনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কিন্তু সেই নির্বাচনও তো হয়ে গেছে। আটকে তো থাকেনি। সব পথের ব্যাপার-স্যাপার এ রকমই। তারপরও পথের কথাটা ওঠে। বলতে হয়। কারণ, এটি জনসাধারণের দিক থেকে সরকারের জন্য একটি সাবধানবাণী বা সতর্কসংকেত। এর চেয়েও বড় কথা, এটা সরকারের সঙ্গে জনগণের মতবিনিময়। যদিও সরকার সবকিছুই জানে। তবে জনগণ তাঁদের নিজেদের জীবনের কথা যতটা জানে, সরকার হয়তো সব সময় ততটা জানে না। জানা সম্ভবও নয়। তাই জনগণকেই উদ্যোগী হতে হয় নিজেদের সেই সব কথা সরকারের কানে পৌঁছানোর জন্য।
তা ছাড়া ওই যে বলা হলো, নির্বাচন হয়ে গেছে। আটকে থাকেনি। এটা যেমন সত্য, তেমনি হয়ে যাওয়ার পরও নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে যে কাটাছেঁড়া কম হচ্ছে না, সেটাও তো সত্য। আরও বড় সত্য হলো, এই কাটাছেঁড়া চলতে থাকবে অনেক দিন ধরে। সরকারের চলার পথে এটাও কিন্তু কাঁটা। যদিও এই কাঁটা রাজনৈতিক। সরকার রাজনৈতিকভাবেই তা মোকাবিলা করবে। কিন্তু জনজীবন-সম্পৃক্ত কাঁটাও রয়েছে অনেক। এর মধ্যে প্রথম ও প্রধান হচ্ছে, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা।
কোভিড-১৯-পরবর্তী বৈশ্বিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সর্বশেষ ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ পুরো পৃথিবীর অর্থনীতিকেই চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য সেই চাপ সামাল দেওয়া খুবই কঠিন। এর ওপর দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত দুর্নীতি, খেলাপি ঋণের ফাঁদে ফেলে ব্যাংকব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে তোলা এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের ফলে সমগ্র অর্থনীতি নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। দেশীয় জ্বালানি সম্পদ আহরণ ও উত্তোলনকে উপেক্ষা করায় এ খাত আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি আমদানি করা যায়নি। যাচ্ছে না। ফলে জ্বালানির সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় দেশীয় উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে রপ্তানির ওপর।
অর্থ পাচার এবং হুন্ডির দুষ্টচক্র দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে টানাটানি ফেলে দিয়েছে। ফলে জ্বালানি এবং গমের মতো কিছু কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিও সীমিত বা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতি হয়ে উঠেছে অসহনীয়। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণের বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্বালানির দাম নির্ধারণে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পাওয়ায় উৎপাদন খাত স্থবির হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও মাসিক বেতন-ভাতা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। বেসরকারি এবং যৌথ উদ্যোগের বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর বিপুল অঙ্কের বিল বাকি পড়ে আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমছে। এগুলো সবই নতুন সরকারের পথের কাঁটা। এগুলো অপসারণ করা খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু দক্ষতার সঙ্গে তা করতে না পারলে, দেশ এবং সরকার বড় রকম বেকায়দায় পড়বে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নতুন সরকার
- সরকারের চ্যালেঞ্জ