ভরা মৌসুমে সবজির অগ্নিমূল্যে অস্থির স্বল্প আয়ের মানুষ
বাংলাদেশে একসময় শীতকালেই সবজি উৎপাদিত হতো। গ্রীষ্মকালে তেমন সবজির দেখা মিলত না। গ্রীষ্মকালে সাধারণত কুমড়াগোত্রের কিছু সবজি যেমন—চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, ঝিঙা, করলা, কাঁকরোল, উচ্ছে এবং অন্য গোত্রের ডাঁটা, পানি কচু উৎপাদিত হতো। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বীজ কোম্পানিগুলোর বারোমাসি সবজির বীজ উদ্ভাবন, বাজারজাত, সম্প্রসারণ কর্মী ও কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশে সবজি চাষে এক নীরব বিপ্লব সংঘটিত হয়। এখন সারা বছরই পাওয়া যায় প্রায় সব ধরনের সবজি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সবজি উৎপাদনে তৃতীয়।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত তখন কিছু লোভী ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগী মজুদদার আটা, তেল, চিনি, চাল, আলু ও পেঁয়াজের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে ভোক্তাকে ফেলেছে মহাবিপদে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার পাইকারিবাজারে মানভেদে আলু ৬২-৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা কেজি দরে। ময়মনসিংহ জেলার হাটবাজারে করলা ১০০ টাকা, টমেটো ৮০, শিম ৮০, মূলা ৩০, বেগুন ৬০, গাজর ৬০ এবং প্রতিটি মাঝারি মানের ফুলকপি ৫০ ও বাঁধাকপি ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। গত বছরও এসব সবজির কেজিপ্রতি দাম ছিল অর্ধেক। বারো মাসের ব্যবধানে দাম বাড়ার হার শতকরা ১০০ ভাগ।
গত ২০ বছর ডিসেম্বরের শেষদিকে আলুর এত দাম কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। আমি সেতাবগঞ্জ সুগার মিলে চাকরির কারণে দেখেছি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, লালমনিরহাট অঞ্চলের কৃষক আমন মৌসুমে আগাম জাতের আমন ধান কাটার পর অক্টোবরের মাঝামাঝি পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ ও মই দিয়ে আগাম জাতের লাল পাকড়ি ও গ্র্যানুলা জাতের আলু রোপণ করেন। রোপণের ৭০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ডিসেম্বরের প্রথমে এ আলু বিক্রি করে কৃষক প্রচুর লাভবান হন। এই সময় পুরনো আলু ১৫-২০ এবং নতুন আলু ৫০-৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়। আলুর দামের সঙ্গে অন্য সবজির দাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আলুর দাম বাড়লে অন্য সবজির দাম বাড়ে। আবার আলুর দাম কমলে অন্য সবজির দাম কমে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩০০ টন সবজি উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে শীতকালীন সবজির পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টন আর গ্রীষ্মকালীন সবজির পরিমাণ ৭৬ হাজার ৪৭ টন। এ বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে আমন ধানের পরিপক্বতা বিলম্বিত হয়। জমিতে সময়মতো সবজি বীজ/চারা রোপণ করতে পারেননি কৃষক। অনেক সবজির চারাও পচে নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় মিধিলার কারণে পাকা আমন ধানসহ শীতকালীন সবজির কম ক্ষতি হয়নি। নোয়াখালীর নয়টি উপজেলায় ১ হাজার ২৩৭ হেক্টর ও চাঁদপুরে ৪২০ হেক্টর জমির মৌসুমি সবজিখেত নষ্ট হয়ে যায় মিধিলার প্রভাবে। এছাড়া টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জেও ঘূর্ণিঝড়ে শীতকালীন সবজির বেশ ক্ষতি হয়।
আমাদের দেশে সাধারণত অক্টোবরের শেষে বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে শীতের শুরু হয়। এ বছর অক্টোবরের ১৮ তারিখে মিধিলার কারণে সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ধান পরিপক্ব হতে বিলম্বিত হয়। পানি জমে থাকার কারণে এ বছর সঠিক সময়ে জমি চাষ করে আগাম শীতকালীন সবজির চাষ করতে পারেননি কৃষক। ফলে নভেম্বর-ডিসেম্বরে বাজারে সবজির জোগান হ্রাস পায় এং চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে সবজির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায় এবং স্বল্প আয়ের মানুষ পড়ে মহাবিপদে। ঘন ঘন হরতাল, অবরোধ এবং সার ও কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি সবজির দাম বাড়ার কারণ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শীতকালীন সবজি
- চড়া দাম