গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালার বাংলাদেশ নিরীক্ষা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আর মাত্র ১০ দিন বাকি। এরই মধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মনোযোগ প্রধানত নির্বাচনী তৎপরতা কেড়ে নিয়েছে। প্রতিযোগিতাটা প্রধানত শাসক দল আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ও স্বতন্ত্ররূপী ‘ডামি’ প্রার্থীর মধ্যে হলেও উভয় পক্ষের বাদানুবাদ, সংঘাত-সহিংসতা ভোট নিয়ে জনমানুষের মধ্যে বেশ কৌতূহল তৈরি করেছে। রাজনৈতিক পরিসরে প্রায় সর্বত্র এখন প্রধান আলোচনা– সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতিশ্রুতিমতো ভোট ‘অবাধ’ ও ‘সুষ্ঠু’ হলে কে জিতবে, আর না হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে।
কিন্তু এর মধ্যেও বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে নতুন গুঞ্জন– ৭ জানুয়ারির ভোট গ্রহণ শেষমেশ না-ও হতে পারে। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে রাজনৈতিক সেলিব্রিটি হয়ে যাওয়া বিএনপির একজন সাবেক নারী সংসদ সদস্যসহ চলমান নির্বাচন বর্জনের পক্ষের অনেকেই বিষয়টি প্রচার করছেন। সম্প্রতি ‘বড়দিনের ছুটি কাটাতে’ ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস দিল্লি গেছেন। মূলত এ বিষয় ঘিরেই তাদের অনুমাননির্ভর প্রচারণা, শেষ মুহূর্তে দিল্লিকে বুঝিয়ে পিটার হাস বিএনপিবিহীন নির্বাচনটি বন্ধ করে দেবেন। যদিও সবাই জানেন, অন্তত বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত সরকারের অবস্থান দৃঢ়ভাবেই মার্কিন চিন্তাবিরোধী। এটি কিছুদিন আগে প্রকাশ্যেই ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জানিয়ে দিয়েছেন।
শুধু তা-ই নয়; আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কর্মসূচিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রধান অতিথি হওয়ার কথা ছিল। শুক্রবার দি হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, ওই অনুষ্ঠানে বাইডেন আসছেন না। তাঁর পরিবর্তে থাকবেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ। হোয়াইট হাউস আনুষ্ঠানিকভাবে এর কারণ না বললেও, তিনি ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন না মূলত দুই দেশের মধ্যে অতি সম্প্রতি সৃষ্ট যুক্তরাষ্ট্রে শিখ নেতা পান্নুন হত্যাচেষ্টার সঙ্গে ভারত সরকারের সংশ্রবজনিত অস্বস্তি এড়াতে। এ অবস্থায় যেখানে বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় দুই কর্মকর্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন একযোগে চেষ্টা করেও বাংলাদেশ বিষয়ে নিজ অবস্থান থেকে ভারতকে টলাতে পারেননি, সেখানে পিটার হাসের মতো নিছক একজন রাষ্ট্রদূত সফল হবেন কী করে!
শুধু বিএনপির এ মাঝারি নেতারা কেন; নাগরিক সমাজেরও একটি অংশ এখনও বেশ জোরেশোরে বলে চলেছে, দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটারের পছন্দের দল বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে শুধু নয়; রীতিমতো দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে রেখে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনটি ‘ইনক্লুসিভ’ বা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ তো নয়ই, অংশগ্রহণমূলকও হবে না। তাই দেশে যেমন-তেমন, অন্তত পশ্চিমাদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনের সর্বশেষ ঘোষিত শ্রমনীতির প্রসঙ্গ টেনে তারা এমনও পূর্বাভাস দিচ্ছেন, নির্বাচন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ‘আংশিক’ হলেও বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেবে। কারণ তাদের ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্র একবার যাকে ধরেছে তাকে সহজে ছাড়ে না। যদিও সম্ভাব্য এ নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তু আমাদের তৈরি পোশাক খাতের নেতারা বলছেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতি অনুযায়ী এক সদস্য দেশ আরেক সদস্য দেশের ওপর কোনো বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে না এবং আমাদের শ্রম পরিস্থিতি বর্তমানে অন্তত নিষেধাজ্ঞার পর্যায়ে নেই।
এটি ঠিক যে, এক সময় আমরা বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্যসহ আরও কিছু পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বিশেষ সুবিধা (জিএসপি) পেতাম, যা এক দশক আগে যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই দেশটি স্থগিত করে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং এ বাহিনীতে কর্মরত ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। দেশটি গত সেপ্টেম্বরে জানিয়েছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারী বাংলাদেশিদের ওপর এরই মধ্যে তারা ভিসা নীতি প্রয়োগ শুরু করেছে, যাদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত। এর ধারাবাহিকতায় আসন্ন নির্বাচনের পর এখানকার কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আসাটা আচানক কিছু নয়।