সমষ্টিগত স্বপ্নটি এখন আর নেই
একাত্তর সালের কথাটি বার বার নানা ভাবে আসে। তা ছিল কঠিন দুঃসময়। আমরা প্রত্যেকেই ভীষণ বিপদে ছিলাম। প্রত্যেকটি দিন, প্রতিটি রাত, এমনকি মুহূর্তও ছিল আতঙ্কের। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েই ভাবতাম, বড়জোর আপনজনদের বিষয়ে, এর মধ্যেও আমরা ব্যস্ত ছিলাম। খবরের আদান-প্রদান করি, কোথায় কী ঘটছে জানতে চাই, রেডিও শুনি, মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে সাহায্য করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করি, আর যারা যুদ্ধে ছিলেন তাদের তো মরণপণ অবস্থা। আমাদের সবার জন্য কাজ ছিল। বিপদ আমাদের তাড়া করছিল; কিন্তু স্বপ্নও ছিল। সামনে একটি স্বপ্ন ছিল। সমষ্টিগত এবং মস্তবড় স্বপ্ন। আমরা আশা করতাম হানাদারদের তাড়িয়ে দেবো, আমরা মুক্ত হবো, আর সেই লক্ষ্যে আমরা কাজও করতাম। যে যেভাবে পারি কাজ করতে চাইতাম।
ওই যে চিন্তা-ভাবনা করা, স্বপ্ন দেখা, দুঃস্বপ্নে শিউরে ওঠা—এসব এখনো চলছে; কিন্তু সমষ্টিগত স্বপ্নটি এখন আর নেই। সবার মুক্তির কথা এখন আমরা আর ভাবি না; ব্যস্ত থাকি নিজেরটি নিয়ে। আমার কী হলো, আমি কী পেলাম—হিসাব এখন সেটিরই। একাত্তরেও নিজের কথা যে ভাবতাম না, তা তো নয়। অবশ্যই ভাবতাম; কিন্তু সেই দুঃস্বপ্নের কালে এটি জানা ছিল আমাদের, আমাদের ব্যক্তিগত মুক্তি সবার মুক্তির সঙ্গে যুক্ত। দেশকে যদি হানাদারমুক্ত না করা যায়, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আমরা কেউ-ই বাঁচবো না। তাই বাঁচার লড়াইটি সর্বজনীন লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবাই এক যে জায়গায় ছিলাম, তা তো নয়। দেশের ভেতরে ছিলাম। ছিলাম আমরা দেশের বাইরে; কিন্তু যেখানেই থাকি, চিন্তা ছিল ওই একটিই, কবে মুক্ত হবে এবং কীভাবে তাড়ানো যাবে হানাদার নরঘাতকদের।
তারপর কী ঘটল? বিজয়ের পর আমাদের অভিজ্ঞতাটি কী? তা একেবারেই ভিন্ন রকমের। দেখা গেল, আমরা আলাদা হয়ে গেছি। আমাদের স্বপ্নগুলো ব্যক্তিগত হয়ে গেছে। আমাদের হাতে সময় নেই সমষ্টিগত স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করার; অথচ সমষ্টিগত কাজ কতো পড়ে রয়েছে! আমাদের দরকার দারিদ্র্য দূর করা। চাই শিল্পে বিনিয়োগ। প্রয়োজন কিঞ্চিৎ মনোযোগী হওয়া। শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়া। এগুলো সবাই মিলে করার কাজ। কারো একার পক্ষে এসব করা সম্ভব নয়; কিন্তু সবাই যে মিলিতভাবে এসব কাজ করবো, তা তো হচ্ছে না। যা করার, ব্যক্তিগত পর্যায়ে করছি।
সবাই মিলে করবো এমনটা কেন হচ্ছে না তা ভেবে দেখার মতো। ভাবতে গেলে মনে হয় কূল-কিনারা নেই। আমরা দোষ দিই রাজনৈতিক নেতৃত্বের। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে আমাদের মুক্তি এনে দিতে পারেনি, তা অবশ্যই সত্য; কিন্তু দেশটি যে স্বাধীন হয়েছে, তা তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণেই। মুক্তির যে আন্দোলন, তাকে তারাই গড়ে তুলেছেন। আমলা, ব্যবসায়ী বা পেশাজীবীরা নন; স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন—যা করার রাজনীতির লোকজনই করেছেন। তারা যে আমাদের অনেক দূর নিয়ে যাবেন, তা করতে পারেননি। একটি সীমা পর্যন্ত এগিয়েছেন, তারপর তাদের যাত্রা শেষ।
হ্যাঁ, রাষ্ট্র দল হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে যে রাষ্ট্রের অধীনে আমরা বসবাস করতাম, তা ছিল অনেক বড়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রের আয়তনকে আমরা ছোট করলাম। বাংলাদেশ এক সময়ের পদকায়নের তুলনায় আরো ক্ষুদ্রকার একটি রাষ্ট্র বটে। এ রাষ্ট্র নতুন; কিন্তু কতোটা নতুন? বড় সমস্যাটা ওইখানেই। আমরা নতুন রাষ্ট্র পেয়েছি, ব্রিটিশ ও পাঞ্জাবিদের যে রাষ্ট্র ছিল, সেই রাষ্ট্রের কাঠামো এবং চরিত্র যেমন ছিল আমলাতান্ত্রিক, স্বাধীন বাংলাদেশও সেই রকমেরই আমলাতান্ত্রিক রয়ে গেছে। বদলায়নি। সেই একই আইন-আদালত, নিয়ম-কানুন, প্রশাসন, বিভিন্ন রকমের বাহিনী এখনো রয়ে গেছে।