৫২ বছরে বিজয়ের কতটা জানি
বাংলাদেশের বিজয়ের বয়স ৫২ বছর। ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে এই বিজয় অর্জন। ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এবং ২ থেকে ৪ লাখ নিরীহ বাঙালি নারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছে। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত বলে অনুধাবন করতে পেরেছে, তখনই তারা তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সহায়তায় নবগঠিত এই দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে পঙ্গু ও ধ্বংস করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী। এই বুদ্ধিজীবীরা হলেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের হত্যা করা হলে নবগঠিত দেশ এগোতে পারবে না। মূলত এটা ছিল নবগঠিত দেশকে মেধাশূন্য ও অচল করার নিকৃষ্ট পদক্ষেপ এবং পাকিস্তানি বর্বরতার নৃশংস পরিকল্পনা।
তাদের এই কাজে সহযোগিতা করতে যারা এগিয়ে এসেছিল, সেই রাজাকার, আলবদর, আলশামস—তারা এদেশীয় বাঙালি বেইমান, বড় বিশ্বাসঘাতক এবং ইতিহাসের কলঙ্ক। শুধু বুদ্ধিজীবীদের হত্যা নয়, পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের পাশবিক কামনা-বাসনা মেটাতে অনেক নিরীহ বাঙালি নারীকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। লজ্জায়, অপমানে এসব নারীর অনেকেই জীবনের পরিসমাপ্তি টেনেছেন পরবর্তী সময়ে। কেউ দেশান্তর হয়েছেন, কেউবা সমাজচ্যুত হয়ে আড়ালবাসী হয়েছেন। যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এই নারীদের নিজের কন্যা বলে পরিচিত করেছেন এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদা হিসেবে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দিয়েছেন।
৯ মাসব্যাপী যে নির্যাতন-নিপীড়ন নারীদের ওপর চালানো হয়, তার পরিসংখ্যানগত প্রতিবেদন পরিপূর্ণ ও যথাযথভাবে করা সম্ভব হলে নির্ঘাত তা পাঠ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম শিউরে উঠত। বর্বরতার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠত। আমি এমন একজন বীরাঙ্গনাকে জানতাম, যাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে সড়কও করা হয়েছে। কিন্তু আর্থিক অভাব-অনটন ও সামাজিক তিরস্কারের কারণে বীরাঙ্গনা বোনটিকে স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে সরে যেতে হয়েছে। যৌনপল্লি তাঁর ঠিকানা হয়েছে।
এমন বীরাঙ্গনা নারীর সংখ্যা কিন্তু কম নয়। কিন্তু তাঁদের জন্য কার কী করণীয় ছিল? মফস্বল, গ্রামগঞ্জে বসবাসরত এমন অনেক নারী আছেন, যাঁরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন। কতজনের খবর কতজনইবা জানেন, জানতে পেরেছেন কিংবা রেখেছেন? যদি এ বিষয়ে সুস্থ ও সুষ্ঠু পরিসংখ্যান করা হতো, করা হতো গবেষণা, তাহলে অন্তত উত্তর পাওয়া সম্ভব ছিল। আর পাকিস্তানিদের বর্বরতা সম্পর্কে জ্ঞান পরিষ্কার এবং স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হয়তো সমর্থ হতো। মুখে মুখে বা লিখিতভাবে ব্যক্তি তাঁর ইচ্ছেমতো, নিজের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, একটা সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, অসম্পূর্ণ ও অসংলগ্ন করা হয়েছে। কাজটি করেছে প্রাদেশিক চিন্তাচ্ছন্ন এদেশীয় কিছু ব্যক্তি, যারা ১৯৭১ সালের রাজাকার, আলবদর, আলশামসেরই গোষ্ঠীভুক্ত। আজও তারা সক্রিয় বিভিন্ন কৌশলে ও আবরণে। মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক ও সর্বজনীন ঘটনাপ্রবাহ লিপিবদ্ধ এবং তা প্রচারে আন্তরিকতার, সততার স্বচ্ছ উদ্যোগ থাকলে অন্তত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, অবমাননা ও অসম্মান প্রদর্শনের দুঃসাহস হতো না কারোর।