মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি কথা আমাদের অনেকটা হতাশ করেছে। কথাটি ছিল, ‘রিজার্ভের সংকট নিয়ে অত চিন্তা করবেন না।’ আমি বলব, তার কথাটি সুচিন্তিত নয়। দেশের রিজার্ভ সম্পর্কে তিনি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে এলেও আইএমএফ আমাদের ঋণ দেবে। কারণ তারা হচ্ছে ঋণ বিক্রেতা। বাংলাদেশ তাদের জন্য ভালো ক্লায়েন্ট। পাকিস্তান দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে থাকার পরও আইএমএফ তাদের ঋণ দিচ্ছে। বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নের নিচে এলেও তারা আমাদের ঋণ দেবে। কিন্তু সমস্যাটা হবে আমাদের। সুতরাং রিজার্ভের সমস্যা নেই কথাটি ঠিক নয়। রিজার্ভের সমস্যাটা তখনই প্রকট আকার ধারণ করবে, যখন আমাদের রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি আসবে। এখন হয়তো সেভাবে কেউ অনুধাবন করছে না। তবে রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে এলে দেশের চলমান মূল্যস্ফীতি আরও উপরের দিকে যাবে। ফলে দরিদ্র শ্রেণি-পেশার লোকদের ভোগের মাত্রা অনেকটাই কমে যাবে। বলতে গেলে দেশের অর্ধেক লোককে দুবেলার জায়গায় একবেলা খেয়ে থাকতে হবে। তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। কারণ অর্থনৈতিক সংকটের ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির হুংকারও বাড়তেই থাকবে। অপরদিকে এসব লোকের তো আর আয়-রোজগার বাড়বে না। সুতরাং সংকটের আবর্তে পড়ে তারাই সবচেয়ে কষ্ট ভোগ করবে। এদিকে সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাংক। বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। বিদেশি কোনো বিনিয়োগ আসছে না বাংলাদেশে। গত এক বছরে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ হয়নি বললেই চলে। শেয়ারবাজারে কিছু বিনিয়োগকারী এসেছিল; কিন্তু এখানে সুবিধা করতে না পেরে তারও চলে গেছে।
শেয়ারবাজারেও একটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। এখন থেকে ১৫ মাস আগে গত বছরের জুলাইয়ে নির্দিষ্ট একটি ফ্লোর প্রাইস ঘোষণা দিয়ে শেয়ারবাজার নীরব ভ‚মিকা পালন করে যাচ্ছে। আর এ কারণে এটা এখন অনেকটা পঙ্গু হয়ে গেছে। মার্কেটে শেয়ার খুব একটা বেচাকেনা হচ্ছে না। শেয়ারবাজারের এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যতটা সম্ভব হয়েছে বিক্রি করে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। আর বাকিটা বিক্রি করতে পারছে না ওই ফ্লোর প্রাইসের কারণে। কেননা ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকা শেয়ারের তো কোনো চাহিদা নেই। চাহিদা না থাকার কারণে বিক্রিও হচ্ছে না। যার ফলে এখানে অল্প কয়েকটা শেয়ার নিয়ে জুয়া খেলা হয়। প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে আউট। কিছু ডে ট্রেডার বা যারা দৈনন্দিন ট্রেড করে, এরা কিছু অ্যাক্টিভ আছে, তবে এরাও সংখ্যায় খুব কম। যে শেয়ারবাজারে দৈনিক টার্নওভার হওয়া উচিত ছিল ২০০০-২৫০০ কোটি টাকা, সেখানে এখন দৈনিক টার্নওভার ৪০০ কোটি। শেয়ারবাজারে কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আজকের এ পরিস্থিতি আমাদের হজম করতে হচ্ছে। যাই হোক, জাতীয় নির্বাচনের আগে শেয়ারবাজার নিয়ে সরকার হয়তো কিছু করবেও না।
তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে একটা ভালো জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন। ভালো নির্বাচন বলতে আমি সবার অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বোঝাতে চাচ্ছি। প্রধান দলগুলোকে নিয়ে অর্থাৎ বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ইসলামি ঐক্যজোট ইত্যাদি সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি নির্বাচন অনেক সমস্যার পথ দেখাবে। এদের অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। বিদেশেও হবে না, দেশেও হবে না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে বিদেশিরাও বিনিয়োগ করবে, স্থানীয় লোকেরাও কাজেকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়বে। দেশে বিনিয়োগ বেড়ে যাবে। তখন সুদের হার একটু কম বা বেশি, সেটা ম্যাটার করবে না। শেয়ারবাজারের ফ্লোর প্রাইসকেও খুব সহজে উঠিয়ে দেওয়া যাবে। ফ্লোর প্রাইস উঠে গেলে শেয়ারবাজারও চাঙ্গা হওয়া শুরু করবে। দেশের অর্থনীতিতে একটা চাঙ্গা ভাব ফিরে আসবে। আর যদি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হয়, তাহলে দেশে একটা রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে এবং সামাজিকভাবে একটা অস্থিরতা বিরাজ করবে। এতে করে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে এবং দেশের অর্থনীতি খুবই দুরবস্থার দিকে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
একটি দেশের অর্থনীতির মাপকাঠি বলতে আমরা কী বুঝি? অর্থনীতির মাপকাঠি বলতে আমরা বুঝি একটা দেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ, বিনিয়োগ, জিডিপির গ্রোথ রেট, প্রাইস লেভেল মুভমেন্ট এবং এক্সচেঞ্জ রেট। এ কয়েকটা বিষয় দিয়ে অর্থনীতি বিচার করা হয়। দেশের অর্থনীতির এ কয়েকটা বিষয় গত এক বছর থেকে আমাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। যেমন, এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে টাকার মূল্য বেশি হারিয়েছে। ইনফ্লেশান যেটা সাড়ে ৫ শতাংশ ছিল, সেটা এখন ১০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। জিডিপি গ্রোথ রেট, যেটা সাড়ে ৭-এ ছিল সেটা ৫-এর মধ্যে নেমে এসেছে। বিনিয়োগ যেটা ছিল ২৯-৩০ শতাংশ, সেটা এখন ২২ শতাংশের দিকে নেমে এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগ সরাসরি নেই বললেই চলে। সবকিছুই দেশের অর্থনীতিকে একটা নেগেটিভ সংকেত দিচ্ছে। বলতে গেলে যেসব বিষয় অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে চাঙ্গা রাখে, তার সবগুলোই নেগেটিভ সংকেত বহন করছে। গত তিন বছরের মধ্যে এ বছর সবচেয়ে কম এলসি খোলা হয়েছে। ফলে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আনা যাচ্ছে না বা আনা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। যার ফলে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশে। কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।